ছবি : সংগৃহীত
দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে রাস্তায় চাঁদাবাজি বন্ধ ও ছাত্রদের বাজার তদারকিসহ বিভিন্ন কারণে কমতে শুরু করেছে সবজি, মুরগি ও মাছসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম। এই ইতিবাচক ধারা যাতে অব্যাহত থাকে- সংশ্লিষ্টদের কাছে সেই তাগিদ দিয়েছে সাধারণ মানুষ।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও কলমিলতা, মহাখালী রেলগেট ও কাঁচাবাজার ঘুরে ক্রেতা-বিক্রেতাদের এমন মনোভাবের কথা জানা গেছে।
শাকসবজির বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দুই সপ্তাহ আগে ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হওয়া কচুর মুখির দাম বর্তমানে ৬০-৭০ টাকা। কেজিতে ১০ টাকা কমে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়, ১০ টাকা কমে আদা ২৩০ টাকা, ২০ থেকে ৪০ টাকা কমে রসুন ২০০ টাকা, ১০ টাকা কমে আলু ৫৫ টাকা, ১০ টাকা কমে ঢেঁড়স ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে করলার দাম। দুই সপ্তাহ আগেও ১২০-১৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া করলা নেমে এসেছে ৬০-৭০ টাকায়। ৪০ টাকা কমে কাঁকরোল এখন ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া বরবটি ২০ টাকা কমে ৮০ টাকা, ঝিঙা ২০ টাকা কমে ৬০ টাকা, ১০ টাকা কমে চিচিঙ্গা ৪০ টাকা, পেঁপে ২০ টাকা কমে ৩০ টাকা, ২০ টাকা কমে টমেটো ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা কেজি।
কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা নাদিম মাহমুদ বলেন, কিছুদিন ধরে কোথাও কোনো চাঁদা দিতে হচ্ছে না। শান্তিতে ব্যবসা করা যাচ্ছে। আমাদের আয়ের বড় একটা অংশ নানা ঘাটে চাঁদা হিসেবে দিয়ে দিতে হতো। আপাতত এ অবস্থাটা নেই। যে কারণে প্রায় সব ধরনের সবজিতেই কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৪০ টাকা দাম কমেছে। রাস্তাঘাটে চাঁদা বন্ধ ও ছাত্রদের বাজার তদারকি অনেক কাজে আসছে।
আজিমপুরের এক বেসরকারি কলেজের শিক্ষক হাসনা জামান, ফার্মগেট এলাকার বাসিন্দা। গতকাল কারওয়ান বাজারে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেভাবে দাম কমার পোস্ট ও বাজারের চিত্র দেখেছি, আসলে ঠিক তার উল্টো। সব সবজিরই দাম কমেছে, তবে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা মাত্র।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সবসময়ই এমন অবস্থা হয়ে থাকে। আমরা চাই সব ধরনের পণ্যে দাম যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা হোক।
কারওয়ান বাজারের মাছ বিক্রেতা মোহাম্মদ খোকন বলেন, প্রায় প্রতিটি জাতের মাছের কেজি গড়ে ৩০ থেকে ৫০ টাকা কমেছে। ১ কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ১৬০০ টাকা ও ১ কেজির নিচে ১৪০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। তাছাড়া রুই ৩৫০, কাতল ৩৮০, পাঙাশ ১৮০, কৈ ২৫০, মলা ৩০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
বাজার ঘুরে আরও দেখা গেছে, ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম কমেছে। তাছাড়া ডিমের দামও কমেছে। ব্রয়লার ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা ও সোনালি মুরগি ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। গতকাল ফার্মের মুরগির লাল ডিম বিক্রি হয়েছে প্রতি হালি ৫০ ও সাদা ৪৮ টাকায়।
মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিংয়ের বাজারের নিয়মিত ক্রেতা আহমেদ রাজু জানান, বাজারটিতে পেঁপে ৩০ টাকা, ঢেঁড়স ৪০, বেগুন ৫০, পটোল ৫০, শসা ৪০, কচুর মুখি ৬০ টাকা কেজি এবং ব্রয়লার মুরগি ১৭০ টাকা, লেয়ার ৩৩০ এবং সোনালি মুরগি ২৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। ডিম এক কেইস (৩০টা) ৩৭০ টাকা।
মহাখালীর মুদি দোকানি তামিম আহমেদ বলেন, ১০ টাকা কমে চিকন মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৩০ ও মোটা ১০৫ টাকা, ২০ টাকা কমে মাষকলাই ১৮০ টাকা, ১০ টাকা কমে মুগডাল ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চাঁদাবাজিকে গরিবের পেটে লাথি মারার সঙ্গে তুলনা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম। তার সঙ্গে কথা হয় তেজগাঁও কলমিলতা বাজারে। তিনি বলেন, গরিবের পেটে লাত্থি দিয়ে কেউ ভালো থাকতে পারে না। রাস্তায় ক্ষুদ্র ও ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে রিকশা, ভ্যানচালকসহ সবাইকে চাঁদা দিতে হয়েছে। এসব কারণে কম আয়ের মানুষের জীবনে কষ্ট আরও বেড়ে গিয়েছিল। আমরা বাজারে যে শাকসবজি কিনি, এসবের পরিবহনের সময় চাঁদা দিতে হয়েছে। এখন অনেকেই বলছেন, চাঁদা কমে গেছে বা দিতে হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। তিনি বলেন, আমাদের গলির রাস্তায় সেসব গাড়ি চলাচল করে, তার জন্য এখনও চাঁদা দিতে হয়। এসব চাঁদা বন্ধ হয়নি। তবে আশা করি, সবাই মিলে বন্ধ করতে পারব।
ফার্মগেট মোড়ে ফল বিক্রি করেন খায়রুল ইসলাম। তিনি জানান, তাকে প্রতিদিন ৫০ টাকা করে চাঁদা দিতে হতো। ফুটপাথের সব দোকানিকেই নানা পরিমাণে চাঁদা গুনতে হতো। এখন প্রায় প্রতিদিন সেনাবাহিনীর সদস্যরা টহল দেন। তারা কাউকেই যেন চাঁদা না দেওয়া হয়, সে নির্দেশনা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, আমরা দিনে আর কত টাকা বিক্রি করি? অথচ চাঁদা দিতেই অনেকের টাকা শেষ হয়ে যেত।
মহাখালীর রেলগেট বাজারের সবজি বিক্রেতা লিয়াকত হোসেন বলেন, কাঁচামালের বাজারে দামের নিশ্চয়তা থাকে না। আজ বাড়ল তো কাল কমবে। দাম বাড়া-কমার বিষয়টা নির্ভর করে আমদানির ওপর। আমদানি বেশি থাকলে দাম কমে, আবার কমে গেলে দামও বেড়ে যায়। এখন রাস্তায় চাঁদাবাজি কম, মালামাল ঢাকায় আসতেও কম সময় লাগছে।
কারওয়ান বাজারের চাল বিক্রেতা আব্দুর রউফ বলেন, চালের দাম জুলাই মাসে যা বেড়েছিল, সেই অবস্থায় এখন আছে। বর্তমানে চালের দাম কমেনি। তিনি জানান, ব্রি২৮ চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি, মিনিকেট ৭০-৭২, নাজিরশাইল ৭২-৮০, আমন ৭০-৭২ ও পাইজাম ৭৫-৭৭ টাকা। আব্দুর রউফ বলেন, ছাত্ররা বাজার তদারকি করতে এসেছিল। আমরা তাদের জানিয়েছিÑ চালের দাম কমাতে হলে মিলগেটে তদারকি করতে হবে। কেননা আমরা যে দামে কিনি, তার চেয়ে দুয়েক টাকা বেশি দামে বিক্রি করি। চালের প্রকৃত অবস্থার তদারকি করতে হবে মিলারদের কাছে গিয়ে।
তিনি আরও বলেন, ছাত্রদের বাজার তদারকির ইতিবাচক ফল আমরা পাচ্ছি। আমরা আড়তদারকে বলতে পারি, চাপে আছি রসিদ দেন। আগে তো যেনতেন রসিদ দিত। এখন পাকা রসিদ রাখতে হয়। এই অবস্থা চলমান থাকলে ক্রেতা-বিক্রেতা সবার জন্যই ভালো।