ওরিয়ন গ্রুপের ওবায়দুল করিম আরেক ব্যাংক রাক্ষস
জোনায়েদ মানসুর
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:৫২ পিএম
এস আলম গ্রুপের মোহাম্মাদ সাইফুল ইসলামেরর নাম সারা বিশ্বে তোলপাড় হওয়ার পাশাপাশি আরেক ব্যাংক খেকোর নাম থলের বিড়ালের মতো বেরিয়ে আসছে। তিনি হলেন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম। ঠাণ্ডা মাথার এ ব্যাংক রাক্ষস নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। এ ঋণ পরিশোধ না করার নানা ফন্দি ফিকির তার মুখস্থ। এ ঋণ ফেরত না দেওয়ার জন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের পকেটে রাখেন সবসময়।
সম্প্রতি তার নানা অপর্কমের খবর বেরিয়ে এসেছে। অপকর্ম ঢাকতে নানা কৌশল বেছে নিয়েছেন তিনি। ঋণ জালিয়াতি, প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, পাচার, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনসহ নানা অপরাধের অভিযোগে এক ডজনেরও বেশি মামলা কাঁধে নিয়ে বছরের পর বছর বহাল তবিয়তে আছেন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম ও তার পরিবাবের সদস্যরা। বেশ কয়েকটি মামলায় তাদের কারাদণ্ড হয়েছে।
সাজা থেকে বাঁচতে মামলার নথি গায়েব, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এবং আইনের ফাঁকফোকরে সময়ক্ষেপণ করে অপকর্মের ধারাবাহিকতা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এর মধ্যে ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকায় উঠে আসে ওবায়দুল করিমের নাম। সেই সময় তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা ঠুকেই বাঁচার চেষ্টা করেন তিনি।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ওরিয়ন গ্রুপের ২২ প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকে মোট ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার ১৪৫ কোটি ২২ লাখ ৫৪ হাজার ৬০৬ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকা। শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ওবায়দুল করিমের মালিকানাধীন ওরিয়ন গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানের নামে শুধু জনতা ব্যাংকেই ঋণ রয়েছে ২ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা।
ঋণের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ওরিয়ন গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বেলহাসা একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম ও তার ছেলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালমান ওবায়দুল করিম একটি ব্যাংক থেকে ১৬৬ কোটি ৩০ লাখ ২১ হাজার ৫০৮ টাকা ঋণ নেন। কিন্তু কোম্পানি তো দূরের কথা, টিআইএন নম্বরেরও খোঁজ মেলেনি। বেলহাসা একম জেভি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম চেয়ারম্যান, এমডি সালমান ওবায়দুল করিম ও স্পন্সর পরিচালক মাজেদ আহম্মেদ সাঈফের নামে ঋণের পরিমাণ ৭৮ কোটি ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৬৪৮ টাকা। ওবায়দুল করিম আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের নামে ৫১ কোটি ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৮৬৮ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর মধ্যে ১২ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৭১৭ টাকা পরিশোধ করেননি। এমনকি এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানা বা অংশীদারত্বের কোনো বৈধ কাগজ পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে।
কার্গো মেরিটাইম লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম এবং এমডি সালমান ওবায়দুল করিম ৪ কোটি ৯ লাখ ৫৯ হাজার ৭০০ টাকা ঋণ নিয়েছেন, যা তারা পরিশোধ করেননি। ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও এমডি মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম, নমিনি পরিচালক আরজুদা করিম নুদারাত, স্পন্সর পরিচালক এস করিম ছয়টি তফসিলি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৪২৬ কোটি ৫২ লাখ ১২ হাজার ৭৪৬ টাকা ঋণ নিলেও খেলাপির পরিমাণ ১ কোটি ৩৮ লাখ ৫৯ হাজার ৭০৫ টাকা। এ ছাড়া নন-ফান্ডেড ঋণ ১৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
ডাচ-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও এমডি ওবায়দুল করিম এবং প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সালমান ওবায়দুল করিমসহ পরিবারের আরও দুই সদস্য ১০২ কোটি ৪৭ লাখ ৩৬ হাজার ৪৩০ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর মধ্যে ৩৯ লাখ ৯৭ হাজার ৯৭৩ টাকার ঋণ পরিশোধ করেননি। এর বাইরে ৯৪ কোটি ৩৮ লাখ ১২ হাজার ৫১০ টাকার নন-ফান্ডেড ঋণও রয়েছে।
কোহিনূর কেমিক্যালস কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম ও পরিচালক মোহাম্মদ এবাদুল করিম সরকার ৬২ কোটি ৩৩ লাখ ৭৭ হাজার ৫০৯ টাকা ঋণ নেন। এর মধ্যে ৮৭ হাজার ৭৫০ টাকা পরিশোধ করেননি। নন-ফান্ডেড গ্যারান্টি বাবদ ব্যাংকের পাওনা ৪৯ কোটি ৬০ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৫ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ঋণ পরিশোধ না করায় ওবায়দুল করিম ও অন্যান্য পরিচালকের ঋণখেলাপি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। কিন্তু উচ্চ আদালতে রিট করে তালিকা থেকে নাম প্রত্যাহার করানো হয়েছে।
ওরিয়ন অ্যাগ্রো প্রোডাক্ট লিমিটেডের নামে ৪৮ কোটি ১৬ লাখ ৭ হাজার ৭১৫ টাকা ঋণ নেওয়া হয়। ওরিয়ন ফুটওয়্যার লিমিটেডের নামে ১৬ কোটি ২০ লাখ ৫৬ হাজার ৮৭২ টাকা ঋণ নিয়ে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ১৭৮ টাকা পরিশোধ করা হয়নি। ওরিয়ন গ্যাস লিমিটেডের নামে ৪৮৯ কোটি ৬ লাখ ২৬ হাজার ৩৫৫ টাকা ঋণ নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৪৭ কোটি ৯৭ লাখ ২১ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেনি। এ ছাড়া নন-ফান্ডেড ঋণ রয়েছে ৭৫ কোটি ৫০ লাখ ৩১ হাজার ৫৪৬ টাকা। ওরিয়ন হোম অ্যাপ্লায়েন্স লিমিটেডের নামে ঋণ রয়েছে ৩৩৪ কোটি ১০ লাখ ৭ হাজার ৫৬৪ টাকা।
ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের নামে ঋণ রয়েছে ৪২১ কোটি ৮৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮৯৪ টাকা। ওরিয়ন নিট টেক্সটাইল লিমিটেডের নামে ২২৫ কোটি ৮৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৬ টাকা ঋণ নিয়ে ২০ কোটি ৮২ লাখ ৪৮ হাজার ৫৬৯ টাকা পরিশোধ করা হয়নি। ওরিয়ন অয়েল অ্যান্ড শিপিং লিমিটেডের নামে ২ হাজার ৫৩৬ কোটি ৬৩ লাখ ৫৮ হাজার ২১৪ টাকা ঋণ নিয়ে ৪০৩ কোটি ৯৯ লাখ ২ হাজার ৮৫৬ টাকা পরিশোধ করা হয়নি। নন-ফান্ডেড ঋণ রয়েছে ৪৭৪ কোটি ১৯ লাখ ৮৪ হাজার ২১ টাকা। ওরিয়ন ফার্মা লিমিটেডের ঋণ ২ হাজার ২২৮ কোটি ৬১ লাখ ৯ হাজার ৫৮৭ টাকা। এর মধ্যে ১২৮ কোটি ৩৬ লাখ ৩৭ হাজার ৩৪১ টাকা পরিশোধ হয়নি। সন্দেহজনক ঋণ ১০১ কোটি ১১ লাখ ৯০ হাজার ৭৫১ টাকা।
ওরিয়ন পাওয়ার রূপসা লিমিটেডের ঋণ ৬৯৭ কোটি ৫২ লাখ ৩২ হাজার ২৩০ টাকা। এর মধ্যে ৫০ কোটি ৬৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ হয়নি। এর বাইরে নন-ফান্ডেড ঋণ হিসেবে ব্যাংকের পাওনা ২২ কোটি ১৩ লাখ ৫৯ হাজার ৩৬০ টাকা। ওরিয়ন পাওয়ার লিমিটেডের ঋণ ১ হাজার ৬ কোটি ৭৮ লাখ ৭৪ হাজার ৭১৮ টাকা। এর মধ্যে ১৩২ কোটি ১২ লাখ টাকা পরিশোধ হয়নি। ওরিয়ন পাওয়ার ইউনিট-২ ঢাকা লিমিটেডের ১ হাজার ৫৪ কোটি ২৬ লাখ ৯১ হাজার ৪৫৬ টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। এলসি বাবদ ব্যাংকের পাওনা ২৪৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।
ওরিয়ন কাদেরিয়া টেক্সটাইলের ঋণ ৪ কোটি টাকা। ওরিয়ন টি কোম্পানির ঋণ ৩৩ কোটি ৯ লাখ ১১ হাজার ৯৯ টাকা। এর মধ্যে ৯ কোটি ৪০ লাখ ২৩ হাজার ৯৪২ টাকা পরিশোধ হয়নি। নন-ফান্ডেড হিসেবে ব্যাংকের পাওনা ৫২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। স্টার অ্যাকসেসরিজের ঋণ ১৫ কোটি ৬৯ লাখ ৪৯ হাজার ৯৯৯ টাকা। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৭ হাজার ৯৯৫ টাকা পরিশোধ হয়নি। নন-ফান্ডেড ২০ লাখ ৫২ হাজার ৪০৬ টাকা এবং এলসি বাবদ ৩ কোটি ১৬ লাখ ৫০ হাজার ৯১৯ টাকা পাওনা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকায় উঠে আসে ওবায়দুল করিমের নাম। সেই সময় তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা ঠুকেই বাঁচার চেষ্টা করেন তিনি। ওই তালিকায় ওবায়দুল করিম ওরফে মোহাম্মদ ওবায়দুল করিমের অন্তর্ভুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ২২ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। পরদিন ২৩ আগস্ট রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ঋণখেলাপির তালিকায় ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিমের নাম অন্তর্ভুক্ত করা স্থগিত করেন হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের বেঞ্চ। একইসঙ্গে তাকে ঋণখেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে চার সপ্তাহের রুল জারি করা হয়। এরপর অন্তত ৯৫টি তারিখ পরিবর্তন হয়েছে। নানা অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সেই মামলার শুনানি হয়নি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৯ মে হাইকোর্টের বিচারপতি ফারাহ্ মাহবুব ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব উল ইসলামের বেঞ্চে শুনানি ধার্য ছিল। এরপর মামলাটি আর কোনো বেঞ্চের কার্যতালিকায় দেখা যায়নি। ২০২১ সালে আদেশের দিন শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের তৎকালীন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার বলেন, ওবায়দুল করিম ২০১২ সালে আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেড থেকে কিছু শেয়ার ক্রয় দেখিয়েছিলেন (১২ দশমিক ৮ শতাংশ)। কিন্তু তিনি আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের পরিচালক নন বা প্রকাশনা দ্বারা প্রাপ্ত ঋণের গ্যারান্টার নন এবং খেলাপি হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পরিমাণ শেয়ারের মালিকও তিনি নন।
ঋণ বিশেষ অনুমোদনে পুনঃতফসিল
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদনে ওরিয়ন গ্রুপের ওষুধ কোম্পানি ওরিয়ন ফার্মা লিমিটেডকে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক থেকে ফোর্সড/ডিমান্ড ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত যখন কোনো ঋণগ্রহীতা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণপত্রের অর্থ দিতে ব্যর্থ হন, তখন সেই পরিমাণ অর্থ ফোর্সড বা ডিমান্ড ঋণে পরিণত হয়। কারণ সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে বিদেশি ব্যাংকের বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের মধ্যে ২০২৩ সালে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) অনুযায়ী, যে কোনো ফোর্স বা ডিমান্ড ঋণ পুনঃতফসিল ও পরিশোধের সময়সীমা দুই বছর বা তার বেশি সময় বাড়াতে হলে ঋণের বিপরীতে শতভাগ জামানত দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ঋণ আদায়ে ঝুঁকি কমাতে ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ ঠেকাতে এ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি অনুযায়ী, অগ্রণী ব্যাংক ওরিয়ন ফার্মার মোট ১ হাজার ৩৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকার ঋণের মধ্যে ১৩২ কোটি ১৮ লাখ টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। একইসঙ্গে এই ঋণ পরিশোধের সময়সীমা ছয় বছর বাড়ানো হয়। অথচ কোম্পানিটির প্রায় ৫৪৭ কোটি টাকার জামানত ঘাটতি ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক গত মে মাসে অগ্রণী ব্যাংককে চিঠি দিয়ে জানায়, ওষুধ উৎপাদন, বিপণন ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে ওরিয়ন ফার্মার ক্ষেত্রে এ সমঝোতা স্মারকের শর্ত প্রযোজ্য হবে না। তবে অগ্রণী ব্যাংকের ওপর দুটি শর্ত আরোপ করেছিল ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা। একটি হচ্ছে ওরিয়ন ফার্মাকে ২০২৫ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে ৫৪৭ কোটি টাকার জামানত ঘাটতি পূরণ করতে হবে। অন্যটি হচ্ছে প্রতি তিন মাস পর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জামানত সংগ্রহের পরিস্থিতি নিয়ে আপডেট তথ্য জানাতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে বিভিন্ন সময় বিধি-বিধান থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ অনুমোদন দিয়ে থাকে।
তিনি বলেন, খাত বা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে এই অনুমোদন দেওয়া হয়, যেমন বিদ্যুৎ বা ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান।
এদিকে ২০২৪ সালের মে মাসে অগ্রণী ব্যাংক পরিদর্শন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল।
তখন দেখা যায়, ১৩২ কোটি ১৮ লাখ টাকার ডিমান্ড ঋণ তৈরির ফলে ওরিয়ন ফার্মার মোট ঋণ ব্যাংক কোম্পানি আইনের একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা অতিক্রম করেছে।
আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক তার পরিশোধিত মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি একক গ্রাহককে ঋণ দিতে পারে না।
এর আগে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ওরিয়ন ফার্মার মোট ঋণ একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে অগ্রণী ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবে পরিদর্শক দল জানতে পারে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে কোম্পানিটির ঋণ বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রতিবছর তাদের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এতে আরও বলা হয়ে, এই নথিগুলোর নির্ধারিত শর্ত ব্যাংকের সকল গ্রাহকের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। তাই কোনো বাছাই করা গ্রাহককে সমঝোতা স্মারকের শর্ত থেকে অব্যাহতি দেওয়া যৌক্তিক নয়।
এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুরশেদুল কবির বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে অগ্রণী ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা দিয়েছে।
এছাড়া পর্যাপ্ত ডাউন পেমেন্ট সাপেক্ষে ওরিয়ন ফার্মার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। তার ভাষ্য, এই সুবিধা দেওয়ার জন্য আমাদের কোনো দোষ নেই।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নথিতে দেখা যায়, ওরিয়ন ফার্মাকে যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৯৬৩ কোটি টাকার অনুমোদন দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। এর একটি অংশ পরে ফোর্সড ঋণে পরিণত হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নথি অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকে ওরিয়ন ফার্মার মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
ওরিয়ন গ্রুপ চেয়ারম্যানের মামলার নথি গায়েব
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিমের মামলার নথি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী তিনি আদালতে হাজির হয়েছেন কি না, এ তথ্যও সংশ্লিষ্ট কারও কাছে নেই। এর ফলে গত ১৪ বছরে গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির পরবর্তী বিচার প্রক্রিয়ার সবকিছু একরকম অন্ধকারে রয়ে গেছে। এ সুবাদে অন্যতম আসামি ওবায়দুল করিমসহ দোষীরা আছেন বহাল তবিয়তে। রহস্যজনক কারণে মামলাটি নিয়ে দায়িত্বশীলদের কোনো নজরদারিও পরিলক্ষিত হয়নি। ওবায়দুল করিম ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যাংক থেকে ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় ২০০৭ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তবে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ না করেই তিনি ২০০৮ সালে ওই রায় বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। রুল শুনানি শেষে ওই বছরই বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় স্থগিত করেন হাইকোর্ট। ২০০৯ সালে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে দুদক। শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে আসামিকে (ওয়াবদুল করিম) বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। নিয়মানুসারে মামলার মূল নথিটি উচ্চ আদালত থেকে বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়। ২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বর সেই নথিপত্র গ্রহণ করেন বিচারিক আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এরপর থেকে এ মামলার কার্যক্রম আর অগ্রসর হয়নি। মামলার মূল নথি খুঁজে না পাওয়ায় বর্তমানে ‘মামলা ও আসামিদের সর্বশেষ অবস্থা’ সম্পর্কে কেউই বলতে পারছেন না। অনুসন্ধানে মামলার নথি গায়েবের চাঞ্চল্যকর তথ্যের বিস্তারিত উঠে এসেছে।
অর্থ আত্মসাতের মামলা ও রায়
২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মতিঝিল থানায় মামলাটি করা হয়। মামলার বাদী ছিলেন দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক আবদুল লতিফ। ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রতারণার মাধ্যমে ওই অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে রাজধানীর মতিঝিল থানায় দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলাটি করা হয়। তদন্ত শেষে এ মামলায় ওবায়দুল করিমসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেওয়া হয়।
২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এর বিচারক মো. ফিরোজ আলম এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিমকে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারায় দোষী করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা জরিমানা এবং জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই বছরের সশ্রম করাদণ্ড দেওয়া হয়। অপর চার আসামিকে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় দোষী করে ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
তারা হলেন ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহ মো. হারুন, এসএভিপি আবুল কাশেম মাহমুদ উল্লাহ, সাবেক এভিপি মো. ফজলুর রহমান ও এভিপি একেএম নেয়ামত উল্লাহ।
এছাড়া অপর আসামি একই শাখার ইও এএনএম রফিকুল ইসলামকে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারায় দোষী করে ১ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও এক মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া ব্যাংক থেকে আত্মসাৎ করা ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হবে বলে রায়ে উল্লেখ করেন বিচারক।
প্রসঙ্গত, তৎকালীন ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের অধিকাংশ শেয়ার ছিল ওরিয়ন গ্রুপের হাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে অনিয়ম ও দুর্নীতি উদ্ঘাটিত হওয়ায় তাদের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করা হয়। এরপর নতুনভাবে মূলধন ইস্যু করে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে মালয়েশিয়াভিত্তিক আইসিবি পিএলসি গ্রুপের কাছে ব্যাংকটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে বর্তমান আইসিবি ইসলামী ব্যাংক নামকরণ করা হয়।
আত্মসমর্পণ না করেই হাইকোর্টে রিট
বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ না করেই রায় ঘোষণার পরের বছর রায় বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন আসামি ওবায়দুল করিম। তার পক্ষে ওই সময় আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক (সাবেক বিচারপতি) রিট প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখেন। রুল শুনানি শেষে ২০০৮ সালের ৪ ডিসেম্বর বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় স্থগিত করেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দুদকের আপিল
২০০৯ সালে হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল (আপিল নং-৩৬/২০০৯) করে দুদক। এরপর আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিতাদেশ বাতিল করেন। একই সঙ্গে আসামিকে (ওয়াবদুল করিম) বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। আপিল বিভাগের এই আদেশের পর উচ্চ আদালত থেকে মামলার নথিপত্র বিচারিক আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
মামলার নথি গায়েব
ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১ পেশকার রাজীব বলেন, ‘এই মামলার নথিটি সেরেস্তায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ের পর উচ্চ আদালত থেকে মামলার রেকর্ডপত্র বিচারিক আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বর বিচারিক আদালতের সংশ্লিষ্ট লোকজন তা স্বাক্ষর করে জমা নেন।