সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আসাদুজ্জামান খানের বিস্তর অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ০৮:২৬ পিএম
আসাদুজ্জামান খানের বিস্তর অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু
বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবার দুদকের জালে ধরা পড়েছেন। কয়েক কর্মকর্তার মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে বস্তায় বস্তায় নিতেন ঘুষ।
এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিস্তর অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের পুরনো হলেও কেউ মুখ খোলার সাহস পায়নি। অবশেষে তার বস্তা বস্তা টাকা ঘুষ গ্রহণ, দুর্নীতি, অনিয়ম ও আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে গতকাল বৃহস্পতিবার অনুসন্ধান দল গঠন করেছে দুদক। কমিশনের প্রধান কার্যালয় থেকে কমিশন সভায় ৫ সদস্যের এই দল গঠন করা হয়েছে। এর প্রধান করা হয়েছে কমিশনের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমকে।
দুদকের উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, কমিশন সভায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট করে বস্তায় বস্তায় ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ শিরোনাম একটি অভিযোগ জমা হয়। সেটা অনুসন্ধানের জন্য সদস্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিন্ডিকেটের অন্য সদস্য ছিলেন যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন, জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেনের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধানের সিন্ধান্ত হয়েছে। একই সঙ্গে কমিশন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব আবুল ফজল মীর ওরফে বাদল, যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ হোসেন ও উপসচিব মাহবুবুর রহমান শেখের বিরুদ্ধে একই সিন্ডিকেটে থেকে দুর্নীতি অনিয়মের অংশীদার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি খতিয়ে দেখেছে বলে কমিশন কর্মকর্তারা জানিয়েছে।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকে জমা হওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, আসাদুজ্জামান খান কামাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই ঘুষ হিসেবে বস্তা বস্তা টাকা নিতেন। পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, কারা অধিদপ্তর, ও ফায়ার সার্ভিস থেকে এই টাকা আদায় করা হতো। এ জন্য তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তিনি। টাকা আদায় বা উত্তোলনে মূল ভূমিকা পালন করতেন ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাস। হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই কামাল-হারুন সিন্ডিকেট। একপর্যায়ে হারুন অর রশীদ অবসরে গেলেও এই মন্ত্রণালয়ের সকল ঘুষ, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। ঝুঁকি এড়াতে টাকাগুলো পাঠানো হয়েছে দেশের বাইরে।
অভিযোগ আরও রয়েছে, বিভিন্ন জেলায় পুলিশ সুপার নিয়োগে সর্বনিম্ন ৮০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত নিতো এই চক্র। এই সিন্ডিকেটের আশীর্বাদ ছাড়া পুলিশের কেউ কোনো জেলায় বা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন পেতেন না। গুরুত্বপূর্ণ জেলায় পুলিশ সুপার হিসেবে পদায়নের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৩ কোটি টাকা নিতেন এই সিন্ডিকেট।
২০২২ সালের ৩০ জুন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান ডিআইজি মোল্যা নজরুল ইসলাম। পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে মোল্যা নজরুলকে গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে পদায়ন করা হয়। নিয়োগ পাওয়ার মাস খানেক আগে হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের কাছে ৫ কোটি টাকার একটি চেক দেন মোল্যা নজরুল। পরবর্তীতে গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে নিয়োগের পর হোটেল ওয়েস্টিনে হারুন অর রশীদকে নগদ ২ কোটি টাকা দেন তিনি। এসময় পূর্বের চেকটি ফেরত নিয়ে মোল্যা নজরুল ৩ কোটি টাকার একটি চেক দেন। পরবর্তীতে বাকি টাকাও দেওয়া হয়। এসব টাকা বস্তায় ভরে পৌঁছে দেওয়া হতো আসাদুজ্জামান খানের খামারবাড়ি সংলগ্ন মনিপুরের বাসায়।
অভিযোগে বলা হয়, মন্ত্রী পুত্র জ্যোতি পুলিশের এক কর্মকর্তাকে বদলি করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। কামাল তাকে জানান, হারুন অর রশীদের সঙ্গে কথা বলতে। এ নিয়ে গত জুন মাসে বাসায় কলহ তৈরি হয়। ক্ষুব্ধ হয়ে বাসায় ব্যাপক-ভাঙচুর করেন জ্যোতি। সেসরকারি সংস্থার (এনজিও) ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ বা ‘এনওসি’ দিতে গিয়ে প্রতি সংস্থা থেকে ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা দিতে হতো আসাদুজ্জামান খানকে। এ সংক্রান্ত প্রমাণও মিলেছে। এরমধ্যে ২০১৮ সালে রাজধানীর উত্তরা এলাকার একটি উন্নয়ন সংস্থার এনওসি নিতে গেলে বিপত্তি শুরু হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তার আগে পুলিশের বিশেষ শাখা, জেলা প্রশাসক, এনএসআই ইতিবাচক প্রতিবেদন দাখিল করে। তারপরও অদৃশ্য কারণে ফাইলটি মাসের পর মাস আটকে রাখা হয় মন্ত্রণালয়ে। বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে মন্ত্রীকে ৮৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। ফার্মগেট এলাকায় কামালের বাসার সামনে টাকার ব্যাগটি দেওয়া হয় তার পরিবারের এক সদস্যের কাছে।
ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সে কোনো সার্কুলার হলেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটি তালিকা পাঠানো হতো। সে মোতাবেক তাদেরকে নিয়োগ দিতে ফায়ার সার্ভিসকে বাধ্য করতেন সাবেক এই মন্ত্রী। ২০২৩ সালে ২ অক্টোবর ৫৩৫ জনকে জনকে নিয়োগ দেয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এরমধ্যে ছিলেন ৪৩৬ পুরুষ ফায়ার ফাইটার, ১৫ জন নারী ফায়ার ফাইটার ও ৮৪ জন গাড়িচালক। নিয়োগ কার্যক্রমের শুরুতেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে ২৫০ জনের একটি তালিকা পাঠানো হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে। সাবেক এই মন্ত্রীর নির্দেশে সেই তালিকা মোতাবেক নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় ফায়ার সার্ভিস। সূত্রমতে, নিয়োগের জন্য জনপ্রতি ৮ থেকে ১২ লাখ টাকা নিতেন কামাল-হারুন সিন্ডিকেট।
এছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে বাসায় ডেকে নিয়ে বস্তায় বস্তায় টাকা নিতেন মন্ত্রী। এসংক্রান্ত অভিযোগও দুদকে জমা হয়েছে।
দুদকের তদন্ত দলের একজন কর্মকর্তা জানান, অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। মন্ত্রী ও তার ঘনিষ্ঠদের ঘুষ দুর্নীতি অনিয়মের বিষয়ে বেশ কিছু অভিযোগ কমিশনে আগে থেকেই জমা হয়েছে। সেগুলো আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করা হবে।