২০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ
সাবেক অর্থমন্ত্রী কামালসহ চার এমপির বিরুদ্ধে তদন্তে দুদক
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৪, ০৭:৫১ পিএম
সাবেক অর্থমন্ত্রী কামালসহ চার এমপির বিরুদ্ধে তদন্তে দুদক
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে অতিরিক্ত ফি বাবদ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি ‘রিক্রুটিং এজেন্সি সিন্ডিকেট চক্র’। দেশটিতে ভালো বেতনের চাকরির ভুয়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে মাত্র দেড় বছরে সিন্ডিকেট চক্রের মালিকানাধীন রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে সাড়ে ৪ লাখের মতো লোক পাঠিয়ে ওই টাকা শ্রমিকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়। যার সঙ্গে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। এমন অনিয়মসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির উপপরিচালক নুরুল হুদার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে বলে দুদক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
দুদক সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে সরকার নির্ধারিত অতিরিক্ত ফি বাবদ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পেছনে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও তার পরিবার, ফেনীর দুই সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এবং ঢাকা-২০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের নেতৃত্বাধীন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র সক্রিয় ছিল বলে জানা যায়।
এই চক্র মাত্র দেড় বছরে তাদের মালিকানাধীন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সাড়ে ৪ লাখের মতো লোক পাঠিয়ে ওই টাকা হাতিয়ে নেন। সব মিলিয়ে ওই সময়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে। যার মধ্যে অতিরিক্ত ফি হিসেবেই নেয়া হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এত শ্রমিক পাঠালেও কাজ করার অনুমতি না পাওয়ায় অনেককেই ফেরত আসতে হয়েছে। সহায় সম্বল হারিয়ে বর্তমানে এই শ্রমিকদের অনেকেই কষ্টে জীবন-যাপন করছেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বিদেশে কর্মী পাঠাতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নেন ফেনীর আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। তার মালিকানাধীন স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেড লাইসেন্স নেয়ার সাড়ে তিন বছরে মাত্র ১০০ কর্মী বিদেশে পাঠায়।
অথচ মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেট চক্রে যোগ দেয়ার পর গত দেড় বছরে দেশটিতে প্রায় ৮ হাজার কর্মী পাঠায় স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেড। নিজাম হাজারীর মতো আরো দুজন সাবেক সংসদ সদস্য এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের পরিবারের দুই সদস্যের রিক্রুটিং এজেন্সি কাজ করেছে এই চক্রে।
এরমধ্যে ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল ৮ হাজার ৫৯২ জন, ঢাকা-২০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের প্রতিষ্ঠান আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল ৭ হাজার ৮৪৯ জন এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ ৭ হাজার ১৫২ জন ও মেয়ে নাফিসা কামালের মালিকানাধীন অরবিটালস ইন্টারন্যাশনাল ২ হাজার ৭০৯ জন শ্রমিক পাঠিয়েছে। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার-নির্ধারিত জনপ্রতি ব্যয় ৭৯ হাজার টাকা নির্ধারিত হলেও সিন্ডিকেটটি নিয়েছে কর্মী প্রতি ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।
জানা যায়, প্রায় চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালের জুলাইয়ে যখন মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলে, তখন কর্মী পাঠানোর জন্য রিক্রুটিং এজেন্সি নির্বাচনের দায়িত্ব পায় মালয়েশিয়া। তাদের কাছে ১ হাজার ৫২০টি রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা পাঠিয়েছিল প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কিন্তু মাত্র ২৫টি এজেন্সির নাম নির্বাচন করা হয়। এজেন্সি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নীতিমালা ছিল না। দেখা গেছে, সাবেক অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল ও তার পরিবার, সাবেক ওই তিন এমপির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতা, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর এবং এ খাতের নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান বিপুলসংখ্যক কর্মী পাঠিয়েছে।
অন্যদিকে, অনেক শ্রমিক মালয়েশিয়ায় গিয়ে নানা জটিলতায় কাজ পাননি কিংবা কেউ কেউ ঋণ করে গিয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছেন। চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের দুর্দশা নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) ওয়েবসাইটে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। যেখানে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনেকেরই দুর্বিষহ, মানবেতর ও অমর্যাদাকর পরিস্থিতির বিবরণ ওঠে আসে।
বিএমইটি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) গত দেড় বছরে মালয়েশিয়া যেতে প্রায় সাড়ে চার লাখ কর্মীর ছাড়পত্র দিয়েছে। যার মধ্যে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ ও মেয়ে নাফিসা কামালের অরবিটালস ইন্টারন্যাশনালের নামে মালয়েশিয়ায় গেছেন মোট ৯ হাজার ৮৬১ জন। চক্র গঠনের সময় আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঐশী ইন্টারন্যাশনাল এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নিউ এজ ইন্টারন্যাশনাল। তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মালয়েশিয়ায় এককভাবে শ্রমিক পাঠানোর শীর্ষে রয়েছে ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বায়রার ওয়েব সাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফেনী-৩ আসনে জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিএমইটি তথ্যানুসারে প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি মধ্যপ্রাচ্যে আড়াই হাজারের মতো কর্মী পাঠিয়েছে। তবে মালয়েশিয়া চক্রে ঢুকে এই এজেন্সি একাই ছাড়পত্র নিয়েছে ৮ হাজার ৫৯২ কর্মীর।
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর দিক দিয়ে পঞ্চম অবস্থান রয়েছে ঢাকা-২০ আসনের সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের প্রতিষ্ঠান আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল। মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার খোলার আগে তাদের তেমন কোনো কার্যক্রম ছিল না। বিদেশে পাঠিয়েছিল মাত্র ২৩৮ কর্মী। তবে মালয়েশিয়া চক্রে ঢুকে তারা শীর্ষ তালিকায় চলে যায়। প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় গেছেন ৭ হাজার ৮৪৯ কর্মী। চক্র গঠনের সময় বেনজীর ছিলেন রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি।
এছাড়া এই চক্রটিতে ছিলেন বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন ওরফে স্বপন। বিএমইটির হিসাবে দেখা যায়, স্বপনের এজেন্সি ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের নামে মালয়েশিয়ায় ৭ হাজার ১০২ শ্রমিক গেছেন। ইশতিয়াক আহমেদ নামের এজেন্সি বিএনএস ওভারসিজ লিমিটেড ও জামাতা গোলাম রাকিবের নতুন এজেন্সি পিআর ওভারসিজ চার হাজারের বেশি কর্মী পাঠিয়েছে।
এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটির ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের (ভাটারা এলাকা) কাউন্সিলর মো. শফিকুল ইসলামের এজেন্সি বিএম ট্রাভেলস লিমিটেড ৭ হাজার ২২৫টি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদের অনন্য অপূর্ব রিক্রুটিং এজেন্সি ২ হাজার ৬০০ কর্মীর ছাড়পত্র নিয়ে লোক পাঠিয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে তাদেরও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার নির্ধারিত জনপ্রতি ব্যয় ৭৯ হাজার টাকা হলেও বাস্তবে নেয়া হয়েছে অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ভেরিটে ইনকরপোরেটেডসহ পাঁচটি সংস্থার গবেষণায় বেরিয়ে আসে, মালয়েশিয়া যেতে গড়ে একজন বাংলাদেশি কর্মী ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা খরচ করেছেন।
গত দেড় বছরে সাড়ে ৪ লাখের মতো লোক পাঠিয়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে এ খাতে। তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি নেয়া হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। শ্রমিকদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেয়ার অভিযোগ উঠলেও ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয়। বরং সিন্ডিকেট তৈরির রাস্তা করা হয়েছে। সবার আগে আমাদের ওই অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে হবে। একই সঙ্গে এ চক্রের হোতাদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগও খতিয়ে দেখা হবে।