ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেলে প্রতিদিন কয়েকগুণ লোকসান গুনতে হচ্ছে। গত বছরের ২৮ অক্টোবর এই টানেলটি উদ্বোধনের পর থেকে দৈনিক আয় ব্যয়ের যে হিসাব দিচ্ছে টানেল কর্তৃপক্ষ, তাতে দেখা যাচ্ছে গড়ে প্রতিদিন যে টাকা আয় হচ্ছে, তার প্রায় চারগুণ বেশি খরচ হচ্ছে।
বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে সব উচ্চ খরচের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছিল তার মধ্যে কর্ণফুলী নদীর নিচে এই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল একটি। যেটি ‘কর্ণফুলী টানেল’ নামে বেশি পরিচিত। প্রায় দশ হাজার সাতশো কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প নির্মিত হয়েছে।
জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে টানেলটির ব্যয় নির্বাহে খরচ হচ্ছে প্রায় ৩৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। বিপরীতে আয় হচ্ছে মাত্র ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। সে হিসাবে বিশাল এ প্রকল্প থেকে প্রতিদিন সরকারের লোকসান গুনতে হচ্ছে ২৭ লাখ ৯ হাজার টাকারও বেশি। তাই এটিকে বিগত সরকারের একটি উচ্চাভিলাষী ও মারাত্মক ভুল প্রকল্প বলে মনে করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। ঋণের টাকায় নির্মিত প্রকল্প থেকে আয় তো দূরের কথা, প্রতিদিনের ব্যয় তোলাও সম্ভব না হওয়ায় টানেলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সূত্র জানায়, গত বছরের আজকের দিনে টানেলটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পরদিনই শুরু হয় যান চলাচল। এরপর থেকে গত এক বছরে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করেছে ১৪ লাখ ১১ হাজার ৪১২টি। এর মধ্যে ৭৬ শতাংশই ছিল হালকা যান বা ছোট গাড়ি। বাসের পরিমাণ ছিল ১০ শতাংশ। ট্রাক ছিল ১২ শতাংশ। অন্য বড় ট্রেইলারের পরিমাণ ছিল ১ শতাংশেরও কম। প্রতিদিন গড়ে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে ৩ হাজার ৯১০টি।
চালুর এক বছরের মাথায় দেখা যায়, টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে যান চলাচল করছে মাত্র ৩ হাজার ৯১০টি। অর্থাৎ সমীক্ষায় দাবি করা সংখ্যার চেয়ে অনেক কম সংখ্যক গাড়ি চলাচল করছে টানেল দিয়ে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, বন্দর নগরী ও আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করতে এই একটি টানেল কতটা দরকার ছিল, তা নিয়ে নীতিনির্ধারকরা সঠিকভাবে পর্যালোচনা করেননি। যেহেতু প্রকল্পের ব্যয় বেশি, তাই এখান থেকে কোনোদিন প্রত্যাশিত আয় হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামসুল হক বলেন, সে সময় টানেলটি নির্মাণের ডিসিশন নিতে রাজনীতি বেশি হয়েছে। সরকারের আমলারা নিজেদের জাহির করতে প্রকল্পটিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে হাজির করতে গিয়ে ভুল সমীক্ষা সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছেন।
যোগাযোগ বিশ্লেষকের দাবি, এখন যে পরিমাণ গাড়ি চলাচল করছে ও আয় হয়েছে, সেটি আস্তে আস্তে আরো কমতে পারে। উদ্বোধনের পর প্রথম মাস অর্থাৎ গত বছরের নভেম্বরে টানেলে গাড়ি চলাচল করেছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩১২টি। সে হিসাবে ওই মাসে প্রতিদিন গাড়ি চলেছে ৫ হাজার ৫৪৪টি।
টানেলের উপ-প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, টানেল একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প। সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এটিকে লোকসানি প্রকল্প বলা যাবে না।
অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম বলেন, ২৩০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণের পর টানেল দিয়ে যান চলাচলের পরিমাণ আরো বাড়বে। আগামী কয়েক বছরে এটি সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করা যাবে না। কাজেই এখান থেকে আয় করে সেই টাকায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। তবে, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ও বে-টার্মিনাল সম্পূর্ণরূপে চালু হলে হয়তো এই টানেলের সুফল পাওয়া যাবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যোগাযোগ ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, সঠিক সমীক্ষা ছাড়া একটি অবাস্তব প্রকল্প ছিল কর্ণফুলী টানেল। এখন কি করে এই লোকসান কমানো যায় আমরা সেই পর্যালোচনা করছি।