ঘুষ লেনদেনের বিশাল নেটওয়ার্ক নির্বাচন কমিশনে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৫০ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য সংশোধন, স্মার্ট এনআইডি কার্ড প্রিন্টসহ জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত অন্যান্য সেবার নামে কোটি কোটি টাকা ঘুষ লেনদেনের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের (বিকাশ ও নগদ) মাধ্যমে নেটওয়ার্কের সদস্যদের মাঝে এ ঘুষ লেনদেন হয়েছে।
নেটওয়ার্কে আছেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও বহিরাগত দালাল। হাজার হাজার এনআইডির তথ্য সংশোধনের নেপথ্যে রয়েছে এ চক্রের সম্পৃক্ততা। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বাইরে কী পরিমাণ নগদ টাকা লেনদেন করেছেন, এর হিসাব পাওয়া যায়নি।
তবে একটি এনআইডির তথ্য সংশোধনেই ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা ঘুস নেওয়ার তথ্য মিলেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই নেটওয়ার্কের এক সদস্য তার ব্যাংক ও বিকাশ অ্যাকাউন্টে বেতনের টাকা ছাড়াই ২ কোটি ১২ লাখ টাকা লেনদেন করেছেন। অথচ তিনি জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের ১৯ হাজার টাকা বেতনের একজন কর্মচারী। ওই দুই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকার ভাগ গেছে অন্তত ১১ জন কর্মচারীর অ্যাকাউন্টে।
আরেক কর্মচারীর ব্যাংক ও বিকাশ অ্যাকাউন্টে পাওয়া গেছে অর্ধকোটি টাকা লেনদেনের তথ্য। তিনিও টাকার ভাগ দিয়েছেন এসব কাজে যুক্ত অন্তত ছয়জনকে। একইভাবে আরও কয়েকজনের ব্যাংক হিসাবে বেতন ছাড়াই বড় অঙ্কের লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
এরমধ্যে একজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৪৮ লাখ ২১ হাজার টাকা, আরেকজনের ১৫ লাখ ৬৬ হাজার এবং অপরজনের অ্যাকাউন্টে ১৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে। বেশ কয়েকজন কর্মচারী ঘুষ নেওয়ার কথা স্বীকারও করেছেন।
দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কর্মরত ইসি এবং ইসির প্রকল্প ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং অ্যাকসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ) দ্বিতীয় পর্যায়’-এর কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী সেবাপ্রত্যাশীদের কাজ করে দেওয়ার বিনিময়ে টাকা নেয়ার চুক্তি করেন।
রাজধানীর বিভিন্ন কম্পিউটারের দোকানিদের যোগসাজশেও এ ধরনের চুক্তি হয়। ওইসব চুক্তি অনুযায়ী এনআইডি সংশোধনের মূল দায়িত্ব পান ঢাকায় কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়করা। তারা অল্পসংখ্যক হারে এনআইডি সংশোধনের দায়িত্ব দেন নেটওয়ার্কের সদস্যদের।
নেটওয়ার্কের সদস্যরা কখনো নিজেদের আত্মীয়স্বজন, আবার কখনো প্রভাবশালীদের নাম ভাঙিয়ে ওইসব এনআইডি দ্রুত সংশোধনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে হাতে হাতে ফাইল নিয়ে যান এবং অনুমোদন করিয়ে নেন।
অনুমোদন হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হাতে হাতে টাকা ভাগবাঁটোয়ারা হয়। কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংক, বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্টে লেনদেন করেন। এতেই কর্মচারীদের হিসাবগুলোয় কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। কেউ কেউ স্বজন ও পরিচিতদের নামেও টাকা লেনদেন করেছেন। এসব কর্মচারীর ঢাকায় ফ্ল্যাট, গাড়ি ও দামি মোটরসাইকেলও রয়েছে।
বর্তমানে এনআইডিতে আইডিইএ-২ প্রকল্পে আউটসোর্সিংয়ে ২২০০-এর বেশি জনবল কাজ করছে। এছাড়াও সেখানে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সশস্ত্র বাহিনী থেকে প্রেষণে আসা কর্মকর্তারাও রয়েছেন। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি টাকা লেনদেন হয়েছে আইডিইএ-২ প্রকল্পের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মো. বুলবুল আহমেদের ব্যাংক ও বিকাশ অ্যাকাউন্টে। ২০০-৩০০ জনের এনআইডি সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে এ অপারেটরের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
তার নামে খোলা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ১৫১১৫......৯৩ নম্বর অ্যাকাউন্টে ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত দুই বছর ১০ মাসে বেতন ছাড়াই লেনদেন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং তার ০১৭২৩....৩৮ বিকাশ নম্বরে এক বছর ১০ মাসে লেনদেন হয়েছে ৩৬ লাখ টাকা। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এ প্রকল্পে নিযুক্ত এ ব্যক্তির মাসিক বেতন সবমিলিয়ে মাত্র ১৯ হাজার টাকা।
এ প্রকল্পের অন্যান্য কর্মচারী মো. মাহবুবুর রহমানকে ৩ লাখ ১৭ হাজার, সফিকুলকে ১৫ লাখ ৭৩ হাজার, সাইফুজ্জমানকে ১১ লাখ ৩২ হাজার, ইমরানকে ৫ লাখ ৭ হাজার, সজীব হোসেনকে ৪৯ হাজার ৫০৫, নেওয়াজ শরীফকে ১৬ হাজার, জায়দুর রহমানকে ৫৮ হাজার ২০০, সরদার আবুল কালাম পাভেলকে ৭২ হাজার ৯০০ এবং মঈনুল গাজীকে ১ লাখ ২৫ হাজার ৭৬০ টাকা দিয়েছেন। একই অফিসের আরেক সহায়ক জুলফিকার আলীর মাধ্যমে বেশি এনআইডি সংশোধন করিয়েছেন বুলবুল। তাকে মোট কত টাকা পরিশোধ করেছেন, সেই তথ্য পাওয়া যায়নি।
মো. বুলবুল আহমেদ ওই পরিমাণ টাকা তার অর্জিত বলে দাবি করেন। কথোপকথনের একপর্যায়ে তিনি বলেন, আমি অনেকের এনআইডি সংশোধনের জন্য স্যারদের কাছ থেকে সুপারিশ করেছি। তারা খুশি হয়ে যা দিয়েছেন, তা নিয়েছি। এতে দোষ কোথায়? অন্য কর্মচারীদের সঙ্গে টাকা লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশি কিছু বলার পারমিশন নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইডিইএ-২ প্রকল্পের এক কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সে ২০০-৩০০টি এনআইডির বিভিন্ন ধরনের সংশোধনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বাীকার করে জবানবন্দিও দিয়েছে। তার হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথন পর্যালোচনা করে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে।
আরেক ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মো. মাহাবুবুর রহমানের ব্যাংক ও বিকাশ অ্যাকাউন্টে অর্ধকোটি টাকা লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ৫৫৫৭০....১৭ নম্বর হিসাবে দুই বছরে বেতন ছাড়াই ৩৮ লাখ এবং গত এক বছর ১০ মাসে ০১৭২২....২৩ নম্বর বিকাশ অ্যাকাউন্টে ১২ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি জানান, কোনো কিছু না বলাই আমার জন্য ভালো। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডাকছেন জানিয়ে তিনি চটজলদি অন্যত্র চলে যান।
এনআইডি বাণিজ্য করে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের কর্মচারী মঈনুল গাজী ২০ লাখ ৬৫ হাজার, ওয়াহিদুজ্জামান খান ১৪ লাখ ৩৪ হাজার, আব্দুস সালাম ১৫ লাখ ৩১ হাজার, জিহাদ হাসান ১২৮টি ট্রানজেকশনে ৫ লাখ ১৪ হাজার, নেওয়াজ শরীফ ৪ লাখ ৮০ হাজার, মো. ফখরুল ইসলাম ১ লাখ ২২ হাজার এবং ফরিদ হোসেন ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা লেনদেন করেছেন। এর বাইরেও অনেক কর্মচারীর নাম পাওয়া গেছে, যারা বিভিন্ন অঙ্কের টাকা লেনদেন করেছেন।
এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে তাদের লেনদেনের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। তারা হলেন শ্রীমঙ্গলের উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আতাউল হক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মাসদু আলম, অফিস সহায়ক মো. মনছুর রহমান ও আবু সাঈদ এবং অফিস সহকারী মো. শাহাবুদ্দিন। নির্বাচন ভবনে সোমবার নির্বাচন কমিশন সচিব শফিউল আজিমের কাছে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এনআইডি সেবার নামে টাকা আদায়, জালিয়াতিসহ অতীতে কিছু অভিযোগ ছিল, যেখানে কমসংখ্যক লোক জড়িত ছিল। এখন দেখছি অনেকের সম্পৃক্ততায় বড় সিন্ডিকেট কাজ করছে। এনআইডি উইং থেকে এ বিষয়ে যেসব সুপারিশ আসবে, তা আমরা বিবেচনা করব। একই সঙ্গে ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কারা জড়িত, তা খতিয়ে দেখা হবে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এনআইডি সেবা সহজীকরণে দিনরাত কাজ করছি। এসব লোকের কারণে অন্য সবার পরিশ্রম বৃথা হয়ে যাচ্ছে।