Logo
Logo
×

জাতীয়

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রক এবং বড় অনিয়মের সর্বেসর্বা ছিলেন শেখ রেহানা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৭ পিএম

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রক এবং বড় অনিয়মের সর্বেসর্বা ছিলেন শেখ রেহানা

বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক কেলেঙ্কারির পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়মের বিষয়টি একাধিক সূত্রে উঠে এসেছে। বিশেষত বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বে ২০০৯-২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকটির বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে তুমুল সমালোচনা হলেও তখনকার সরকার বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

শেখ রেহানা এবং তার ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান, পরিচালক এবং এমডি পদে নিয়োগে তার সুপারিশ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে সালমান এফ রহমান এবং চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের প্রভাবও উল্লেখযোগ্য। তারা প্রার্থীদের কাছ থেকে ঘুষ নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রে করপোরেট গ্রুপগুলো পরিশোধ করত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এর পাশাপাশি অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপসহ প্রভাবশালী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এসব ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকোর ঋণের স্থিতি বর্তমানে ২৬ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

এছাড়া বিদেশে অর্থ পাচার ও সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগও উঠেছে শেখ রেহানা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে। তাদের লন্ডনে একাধিক বাড়ি থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে রাশিয়ার পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তিতে মধ্যস্থতার অভিযোগও রয়েছে।

২০১২ সালে যুক্তরাজ্যে সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডের পরিচালন ব্যর্থতায় ব্যাংকটি বন্ধ হয়ে যায়। তখনকার শীর্ষ নির্বাহী মো. আতাউর রহমান প্রধান দেশে ফিরে পুরস্কৃত হন এবং পরবর্তীতে সোনালী ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এই দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা চরম বিপর্যস্ত হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাখ্যা চাইলে তারা অধিকাংশ সময় বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বা মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছেন।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ঋণ কেলেঙ্কারি, আর্থিক অব্যবস্থাপনা এবং লুটপাটের ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সোনালী ব্যাংকের "হলমার্ক" কেলেঙ্কারি, যেখানে প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা লোপাট হয়, ছিল অন্যতম বড় ঘটনা। তবে সোনালী ব্যাংকের তুলনায় অগ্রণী, জনতা, রূপালী, এবং বেসিক ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৬,৬২৩ কোটি টাকায় দাঁড়ালেও এটি বিতরণকৃত ঋণের মাত্র ১৬ শতাংশ, যা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। অন্যদিকে, অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৬,৮৯২ কোটি টাকা হলেও ডিসেম্বরের শেষে তা ৩০,০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, যা মোট ঋণের ৪০ শতাংশ। ব্যাংকটি এখন দৈনন্দিন খরচ মেটাতে বাজার থেকে ঋণ নিচ্ছে।  

জনতা ব্যাংকের অবস্থাও আরও শোচনীয়। এর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬০,৪৮৯ কোটি টাকা হলেও বাস্তবে তা ৭৪,০০০ কোটি টাকার বেশি, যা বিতরণকৃত ঋণের ৭৫ শতাংশ। মাত্র পাঁচটি গ্রুপ বা পরিবার জনতা ব্যাংকের মোট ঋণের অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ ৪৯,৯৫৯ কোটি টাকা নিয়েছে। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপ একাই নিয়েছে ২৫,০৮০ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সেপ্টেম্বরে ১২,৭৩৮ কোটি টাকায় পৌঁছালেও এটি বর্তমানে মোট ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশ। একইসঙ্গে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি এবং আর্থিক পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। অন্যদিকে, বেসিক ব্যাংক গত ১১ বছরে প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকা লোকসান করেছে এবং এর বিতরণকৃত ঋণের ৬৫ শতাংশই খেলাপি। সরকারের আর্থিক সহযোগিতা সত্ত্বেও এ ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে।  

ঋণ বণ্টনের নামে ব্যাংকগুলো থেকে লাখ কোটি টাকার ১৫-২০ শতাংশ ঘুষ হিসেবে বিতরণ হয়েছে। আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা এসব ঋণের বড় অংশ নিয়েছেন। বিশেষত জনতা ব্যাংকের মোট ঋণের একটি বড় অংশ বেক্সিমকো, এস আলম, এবং এননটেক্স গ্রুপের দখলে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের এমডি এবং চেয়ারম্যানদের নিয়োগে ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাবের কথা উঠে এসেছে। অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি শামস-উল-ইসলাম তার বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করলেও তার দায়িত্ব পালনকালে প্রভাবশালী গ্রাহকদের ঋণ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।  

গত দেড় দশকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক সংকট মূলত অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক প্রভাব, এবং লুটপাটের কারণেই ঘটেছে। হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ হলেও অনেক ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিচারের আওতায় আনা যায়নি। এসব ব্যাংকের অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধার করা এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
Email: [email protected]

অনুসরণ করুন