অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বব্যাপী বিপুল সমর্থন ও বিশ্বাস অর্জন করেছে : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

যুগেরচিন্তা২৪ ডেস্ক
প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৪২ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, গত ছয় মাসে বাংলাদেশ বিদেশি দেশগুলোর কাছে এই আস্থা অর্জন করেছে যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার সঠিক পথে রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের বিদেশি বন্ধুদের মধ্যে সন্দেহ ছিল। তারা ভাবছিলেন, এখানে কী হচ্ছে এবং এরপর কী হবে? আমি বিশ্বাস করি আমরা তাদের আশ্বস্ত করতে পেরেছি যে বাংলাদেশ সঠিক পথেই এগোচ্ছে।’
মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে কিছু বাধা আসা অনিবার্য ছিল। গত ছয় মাসে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সরকারের অর্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সেই চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি এবং বিশ্বব্যাপী বিপুল সমর্থন পেয়েছি।’
তিনি উল্লেখ করেন, অর্থনীতি বা রাজনীতি- সবক্ষেত্রেই দেশ সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছে এবং ‘আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এটা সফলভাবে বোঝাতে পেরেছি।’
উপদেষ্টা আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূস গত ছয় মাসে অনেক আন্তর্জাতিক সমাবেশে যোগ দিয়েছেন এবং যথাযথ সম্মান অর্জন করেছেন।
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডে আমরা ড. ইউনূসের বিশ্বব্যাপী সম্মানকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছি।’
তিনি আরও জানান, বাণিজ্য এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে, যদিও অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে ‘আমাদের রপ্তানি স্থিতিশীল রয়েছে।’
উপদেষ্টা আরও উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ রেমিট্যান্সের সমস্যায় ভুগছে। কিন্তু এসব সমস্যাও সমাধান করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখাই অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য এবং আমরা বিশ্বাস করি আমরা তা সফলভাবেই করতে পেরেছি।’
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক
তৌহিদ হোসেন বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক বজায় রাখার কোনো কারণ নেই। ‘আওয়ামী লীগ শাসনামলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক টানাপোড়েনে রাখার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চেষ্টা ছিল, তবে আমরা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে কাজ করেছি। পাকিস্তানও সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে এবং আমরা তা স্বাগত জানিয়েছি।’
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বিবেচনায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে এবং এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে দুই দেশের মধ্যে সমুদ্র যোগাযোগ পুনরায় চালু করা উভয়ের জন্যই লাভজনক হবে।
উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও দুই দেশের মধ্যে কিছু সমস্যা অমীমাংসিত রয়ে গেছে। তবে ‘যদি আমরা এই বিষয়গুলিতে স্থির থাকি, তাহলে কোনো পক্ষই লাভবান হবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা অবশ্যই আমাদের স্বার্থ রক্ষা ও পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করব। তবে একই সঙ্গে আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে অন্য যে কোনো দেশের মতোই দেখতে চাই।’
তৌহিদ হোসেন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ইসলামাবাদের সঙ্গে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সম্পর্ক দেখতে চায় না, বরং নতুন করে যোগাযোগের মাধ্যমে সর্বাধিক সুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে।
তিনি আরও বলেন, এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশ পাকিস্তানের বেসরকারি বিমান সংস্থা জিন্নাহ এয়ারের করাচি-ঢাকা সরাসরি ফ্লাইট পুনরায় চালু করার অনুমতি দিয়েছে।
উপদেষ্টা জানান, পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এপ্রিল মাসে ঢাকা সফর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক
তৌহিদ হোসেন স্বীকার করেছেন যে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্কে অস্বস্তি বিরাজ করছে এবং ‘এটি অস্বীকার করার কোনও মানে নেই।’
রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পদত্যাগের পর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান নিয়ে উদ্ভূত জটিলতাগুলোকেও তিনি স্বীকার করেছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে অস্বস্তির অনুভূতি তৈরি হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা নয়াদিল্লির সঙ্গে এই অস্বস্তি দূর করার চেষ্টা করেছি।
তবে উপদেষ্টা জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের সঙ্গে এমন একটি সম্পর্ক স্থাপন করা, যা পারস্পরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে এবং উভয় দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে পারে এবং ‘সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’
তৌহিদ হোসেন বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের টেলিফোনে কথোপকথন এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ফাঁকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকসহ দ্বিপাক্ষিক আলোচনাগুলো উন্নত সম্পর্কের ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, ‘কিছু বাধা আসতে পারে, এটা স্বাভাবিক। উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এলে বাধা আসে। আমরা উভয় পক্ষের সুবিধার জন্য এই বাধাগুলো কাটিয়ে একটি ভালো কার্যকরী সম্পর্ক তৈরি করতে চাই।’
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক
তৌহিদ হোসেন জানান, সাম্প্রতিক পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বেইজিং সফরে দ্বিপাক্ষিক বিষয়, উন্নয়ন প্রকল্প ও বাণিজ্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। ঢাকা চীনকে তার নীতিগত অবস্থান সম্পর্কে আশ্বস্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে এবং আমরা আশাবাদী যে সম্পর্ক সঠিক পথে এগুবে ও অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে।’
উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, পূর্ববর্তী সমস্ত সরকার চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং ‘এটি অব্যাহত রাখা আমাদের লক্ষ্য’।
তিনি বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বেইজিংয়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের উপর কোনও প্রভাব ফেলবে না।
চীন দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা জোরদার এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, চীন ঢাকার নিকটবর্তী কুনমিংয়ে বাংলাদেশীদের জন্য দুটি থেকে তিনটি হাসপাতাল মনোনীত করেছে। কারণ বাংলাদেশী রোগীরা ভারতের চিকিৎসা ভিসা পেতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন।
তিনি বলেন, 'ভারতের সঙ্গে ভিসা সমস্যা অব্যাহত থাকায়, আমরা চিকিৎসার জন্য একটি বিকল্প গন্তব্য খুঁজছিলাম। আমরা বিশ্বাস করি যে, এটি একটি কার্যকর বিকল্প হবে।'
চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের আমন্ত্রণে ২০-২৪ জানুয়ারি বেইজিং সফরে যান তৌহিদ হোসেন। তিনি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন এবং চীনা ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সাংহাই সফর করেন।
তিনি বলেন, 'আমরা উন্নয়ন প্রকল্প ও বাণিজ্যসহ সব দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি বেইজিংকে ঋণের সুদের হার কমাতে এবং ঋণ পরিশোধের সময়কাল ২০ বছর থেকে ৩০ বছর বাড়ানোর অনুরোধ করেছি।'
তৌহিদ হোসেন বলেন, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘ঋণ পরিশোধের সময়কাল বাড়ানোর বিষয়ে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন এবং সুদের হার কমানোর অনুরোধটি খতিয়ে দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক
তৌহিদ হোসেন বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে ঢাকা মনে করে না।
তিনি বলেন, ‘আমাদের অনুমান করার কিছু নেই, তবে আমরা আশা করি, ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকবে।’
ট্রাম্পের সাহায্য হ্রাসের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বলতে গিয়ে উপদেষ্টা এটিকে ‘প্রত্যাশিত’ বলে বর্ণনা করেছেন এবং সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ইউএসএইড-এর অস্থায়ী সাহায্য স্থগিতাদেশ কোনও নির্দিষ্ট দেশকে লক্ষ্য করে নয়।
তিনি বলেন, ‘নতুন মার্কিন প্রশাসন এমন নীতি চালু করেছে, যা পূর্ববর্তী প্রশাসনের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন। আমাদের চূড়ান্ত ফলাফল দেখতে হবে এবং সেই অনুযায়ী মানিয়ে নিতে হবে।’
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘যখন নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়, তখন আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য কৌশলগতভাবে কাজ করতে হয়।’
ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশকে ভারত, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। কারণ এই তিনটি দেশ আমাদের জন্য কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে।
তিনি বলেন, ‘ভারত, চীন ও আমেরিকার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অবশ্যই আমাদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করে এই তিনটি দেশের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখব।’