Logo
Logo
×

মতামত

রমজানে রোজা রাখার প্রস্তুতি, দেহ ও মনকে সুস্থ রাখতে করণীয়

Icon

যুগেরচিন্তা২৪ ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৪:১৭ পিএম

রমজানে রোজা রাখার প্রস্তুতি, দেহ ও মনকে সুস্থ রাখতে করণীয়

ছবি : সংগৃহীত

পবিত্র রমজান মাস ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য সংযম ও শৃঙ্খলা অনুশীলনের এক পরম সুযোগ। ইবাদত-বন্দেগীর পাশাপাশি এই আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি দৈহিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্র তৈরি করে। ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত একটানা পানাহার থেকে বিরত থাকা স্বাভাবিক জীবন ধারণে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসে। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য শরীর ও মন দুটোকেই আগে থেকে প্রস্তুত করা উচিত। চলুন, রমজানে রোজা রাখার প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা কী এবং এর বাস্তবায়নের জন্য কী ধরণের কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে- তা বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

রমজানে মাসব্যাপী রোজা রাখতে স্বাস্থ্যগত পূর্বপ্রস্তুতি কেন জরুরি

পুরো এক মাস টানা রোজা রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো স্বাস্থ্যগত জটিলতা। সব রকম পানাহার থেকে বিরত থাকার পরেও পর্যাপ্ত শক্তির মাত্রা বজায় রাখার জন্য শরীরকে প্রস্তুত করা দরকার। খাওয়া এবং ঘুমের ধরণে আকস্মিক পরিবর্তনের ফলে ক্লান্তি, পানিশূন্যতা এবং হজমের সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে মাসের প্রথম রোজাগুলোতে এরকম অবস্থা সৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক।

তাই রমজানের আগেই খাদ্যাভ্যাসে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনা হলে এই ধাক্কা সামলানো সহজ হয়ে ওঠে। এই প্রস্তুতি শরীরে শক্তির ভারসাম্য এবং মনোনিবেশে সহায়তা করে, যা রমজানের ধর্মীয় মাহাত্ম্য বজায় রাখার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম, পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে শরীর দীর্ঘ সময় আহার থেকে বিরত থাকার সময়কে মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় সহনশীলতা অর্জন করে। এই সঙ্গতিপূর্ণতা কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ব্যতীত রমজান পরবর্তী তিন বেলা আহারের জীবনে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রেও সহায়ক।

প্রতি বেলার আহারে সময়ানুবর্তিতা

প্রস্তুতিপর্বটা শুরু করতে হবে রমজানের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে ধীরে ধীরে খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনার মাধ্যমে। আসন্ন রোজার সময়সূচির সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নিতে ভারী খাবারের পরিবর্তে নিয়মিত বিরতিতে হাল্কা খাবার গ্রহণ করা যায়। সারা দিনের জন্য ডিনারের উপর নির্ভরশীলতা কমানো উচিত। কেননা এই অভ্যাস হজমকে ব্যাহত করে এবং রোজার সময় অস্বস্তি সৃষ্টি করে।

পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের প্রতি অধিক মনোযোগী হতে হবে। বীজ জাতীয় খাবার, ফল এবং চর্বিহীন প্রোটিন দীর্ঘ সময় ধরে শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে রাখতে সাহায্য করে। অপরদিকে চিনি ও অস্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার শরীরের দুর্বলতার কারণ হয়। এই নতুন খাদ্যাভ্যাস ভোর রাতে খেয়ে সারা দিন রোজা রাখার জন্য শরীরকে ভারসাম্যপূর্ণভাবে তৈরি করে।

সব সময় হাইড্রেটেড থাকা

সমগ্র মাসব্যাপী রোজা মানে প্রতিদিন এক বিপুল পরিসরের সময় শরীরের অভ্যন্তর ভাগ শুষ্ক থাকা। এ অবস্থায় শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তির যোগানের জন্য আগে থেকেই নিয়মিত পানি খাওয়া অত্যন্ত জরুরি। শরীরের পর্যাপ্ত হাইড্রেশনের জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি পান করার প্রয়োজন। নারকেলের পানি, তাজা ফলের রস এবং তরমুজের মতো পানিসমৃদ্ধ ফলগুলো হাইড্রেশনের জন্য সহায়ক। এভাবে শরীরের প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা পূরণ করলে রোজার সময় ক্লান্তি, মাথাব্যথা এবং অন্যান্য ডিহাইড্রেশন-সংক্রান্ত লক্ষণগুলো থেকে মুক্ত থাকা যাবে।

স্বাস্থ্যকর ঘুমের অভ্যাস

দীর্ঘ মেয়াদে শরীরকে সুস্থ ও সতেজ রাখতে স্বাস্থ্যকর ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। সেহরি ও ইফতারের সময়গুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য করার জন্য আগে থেকেই ঘুমের সময়সূচিতে পরিবর্তন আনতে হবে। যারা রাতে খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন, তাদের জন্য এই পরিবর্তন আনা অনেকটাই সহজ ব্যাপার।

ঘুমের অনিয়ম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে এবং হজমে ব্যাঘাত ঘটায়। এতে করে দেহের সামগ্রিক শক্তির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলশ্রুতিতে রোজা রাখার মুহূর্তগুলো ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে রাতে দ্রুত ঘুমাতে যাওয়া এবং ভোরের কিছুক্ষণ আগে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করা হলে রমজানের রুটিনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সহজ হয়। ঘুমের এই অনুশীলন কেবল শরীরের জন্যই নয়, মনের স্বাস্থ্যের জন্যও উপযোগী।

আহারে ধীরে ধীরে ক্যাফেইন এবং চিনির পরিমাণ কমানো

রোজার প্রথম দিনগুলোতে আকস্মিকভাবে ক্যাফেইন ও চিনি গ্রহণ থেকে বিরত থাকা মাথাব্যথা, বিরক্তি এবং ক্লান্তির কারণ হতে পারে। এই উপসর্গগুলো এড়াতে রমজান মাসের আগে থেকে ধীরে ধীরে এ ধরণের খাদ্য উপাদানগুলো পরিহার করা উচিত।

কফি, এনার্জি ড্রিংক্স এবং চিনিযুক্ত স্ন্যাকসের বদলে ভেষজ চা এবং তাজা ফল খাওয়া শুরু করা যেতে পারে। চিনি ও ক্যাফেইনের এই ক্রমান্বয়ে হ্রাস শরীরকে আকস্মিক ধাক্কা থেকে রক্ষা করবে। এছাড়া পরিশোধিত চিনি গ্রহণ কমিয়ে দেওয়া রক্তে শর্করার মাত্রাকে স্থিতিশীল করে ও ক্ষুধা হ্রাস করে। এটি সারা দিন ধরে শক্তি ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট কার্যকর।

প্রাত্যহিক জীবনকে একটি নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা

পুরো রমজান মাস জুড়ে রোজা রাখা সম্পূর্ণ একটি নতুন জীবন ধারণের সমতূল্য। তাই নতুন নিয়মের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য যথাযথ মানসিক প্রস্তুতি অপরিহার্য। রমজানের প্রথম দিন থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সবকিছু বদলে ফেলার পরিবর্তে আগে থেকে ধীরে ধীরে পবির্তন আনা উচিত।

ইবাদত-বন্দেগী থেকে শুরু করে ঘুম ও খাওয়া-দাওয়া প্রতিটি কাজের জন্য নতুন রুটিনে অভ্যস্ত হওয়া শুরু করতে হবে। ধৈর্য্য ধারণের উপর অধিক মনোনিবেশ করা জরুরি। এর সঙ্গে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত করা হলে তা মানসিক চাপ কমানোর জন্য সহায়ক হবে।

অপ্রয়োজনীয় কাজ এবং বিভ্রান্তি থেকে দূরে থাকতে হবে। এর পরিবর্তে ইবাদতের পাশাপাশি সৃজনশীল কাজের প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে।

সহনশীলতার অনুশীলন

রোজার দিনগুলোতে মানসিক উন্নতির পাশাপাশি শারীরিক সুস্থতার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দক্ষতা হলো সহনশীলতা বা ধৈর্য্য। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও রোজা পালনে ধৈর্য্যের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। এর সঙ্গে মানসিক নিয়ন্ত্রণের অনুশীলন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম বা হাল্কা ধ্যান দিয়ে এই অনুশীলন শুরু করা যেতে পারে। এই ক্রিয়াকলাপ কঠিন মুহূর্তগুলো অতিক্রম করতে সাহায্য করবে। একজন সহনশীল ব্যক্তি তার চিন্তাগুলোকে সুসংগঠিত করতে পারেন, যা তার উদ্বেগ কমাতে এবং মনকে শান্ত করতে কাজে লাগে।

একই সঙ্গে নিজের সময়টাও কাটাতে হবে সমমনা লোকদের সঙ্গে। ধর্মীয় বিষয়ে সৃজনশীল আলোচনা পরস্পরের মধ্যে রোজা রাখার উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। মসজিদে গিয়ে সবার সঙ্গে একত্রে নামাজ পড়া এবং গরীব-মিসকিনদের সাহায্য করা মানসিক জীর্ণতা দূর করার মোক্ষম উপায়। এতে মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটে, যা ক্ষুধা বা ক্লান্তির মতো কঠিন মুহূর্তগুলো মোকাবিলা করার উৎকৃষ্ট হাতিয়ার।

কুরআন তেলাওয়াতের প্রয়োজনীয় অ্যাপস ব্যবহার

বর্তমান সময়ের সমগ্র জীবন যখন প্রযুক্তিতে নিমজ্জিত, তখন সেই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা যেতে পারে ইবাদতের কাজে। এখন কুরআন পড়া ও শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে মোবাইল অ্যাপ্স রয়েছে। এগুলো ঘরে ও বাইরে যেকোনো স্থানে চলতে ফিরতে কুরআন পাঠ বা দোয়ার মধ্যে থাকার জন্য যথেষ্ট উপযোগী।

‘তার্তিল’, ‘দ্বীন’, ‘মুসলিম বাংলা’, এবং আল কুরআন (তাফসির অ্যান্ড বাই ওয়ার্ড)-এর মতো অ্যাপগুলোতে সাবলীলভাবে কুরআন পড়া এবং শোনা যায়। এগুলোতে রয়েছে ভয়েস-কমান্ড, বুকমার্ক, এবং সঠিক উচ্চারণ যাচাইয়ের ফিচার। এছাড়াও এগুলোর শাব্দিক অনুবাদ ও তাফসিরের সুবিধাগুলো কুরআন গভীরভাবে বোঝার জন্যও উপযোগী।

স্মার্টফোনে অতিক্রান্ত সময় নিয়ন্ত্রণ

ইবাদতের প্রতি মনোনিবেশ এবং সহনশীলতা বিনষ্টকরণের একটি প্রধান কারণ হচ্ছে স্মার্টফোনে অতিরিক্ত সময় দেওয়া। প্রয়োজনীয় কাজের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিনোদনমূলক অ্যাপগুলোতে দিনের একটা বিরাট অংশ অতিবাহিত হয়। এতে উৎপাদন ও সৃজনশীল কাজের প্রতি নিরুৎসাহ সৃষ্টি হয়। সেখানে রমজান মাসে এই কার্যকলাপ ধর্মীয় কার্যক্রমের প্রতি উদাসিন করে তোলে। ফলশ্রুতিতে নষ্ট হয় রোজা পালনের ভাবমূর্তি। তাই স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করে গরীব-মিসকিনদের সাহায্য, কুরআন পড়া ও তাফসির আলোচনা এবং নামাজ পড়ার প্রতি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। উপরন্তু, স্মার্টফোনের নীল আলো ঘুমের জন্যও ক্ষতিকর, যা গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকার দিকে ধাবিত করে। ফলে সেহরি ও ফজরের নামাজ বাদ পড়ে যায় এবং পরবর্তীতে সারাদিন পানাহার থেকে বিরতি থাকার অভিজ্ঞতা অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।

পরিশিষ্ট

কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়া সঠিক ভাবগাম্ভীর্য মেনে রমজানের রোজা পালনের জন্য শারীরিক ও মানসিক পূর্বপ্রস্তুতি অপরিহার্য। নিত্যদিনের আহার ও ঘুমে রুটিন মেনে চলা এবং সার্বক্ষণিক হাইড্রেটেড থাকা শরীরকে যেকোনো দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে। অপরদিকে, নিয়মতান্ত্রিক জীবনধারণ এবং সহনশীলতার চর্চা মননশীলতা বিকাশে সহায়ক হবে। এই পদ্ধতিতে ত্বরান্বিত করতে পারে কুরআন তেলাওয়াতের অ্যাপ ব্যবহার এবং স্মার্টফোন ব্যবহারে পরিমিতিবোধ। সার্বিকভাবে এই পদক্ষেপগুলোর যথাযথ অনুসরণের সম্ভব সুস্থ দেহ ও মন নিয়ে পুরো রোজার মাসটি অতিবাহিত করা।

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
Email: [email protected]

অনুসরণ করুন