বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বাঙালিকে বুকের তাজা রক্ত দিতে হয়েছে। ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলে বাংলা ভ‚খণ্ড ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরের বছরেই অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গ। সেই ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করার জন্য পূর্ব বাংলার মানুষ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যে নীলনকশা আঁকা হয় তার রক্তাক্ত সমাপ্তি ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এদিন বাংলা মায়ের কয়েকজন ভাষাসৈনিক শহীদ হন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে যারা সেদিন অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে যাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় তিনি হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবুর রহমান একজন সংগ্রামী ভাষাসৈনিক ছিলেন। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভের আন্দোলনে শেখ মুজিবের অনন্য ভূমিকা ছিল। আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থ দুটি পাঠ করি, তাহলে এ কথার সত্যতা দেখতে পাই। ভাষা-আন্দোলনে গ্রেপ্তার হয়েও জেলখানা থেকে কীভাবে শেখ মুজিব বাইরের নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন সেটা ভাবলে অবাক হতে হয়। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি’ গ্রন্থ লিখতে গিয়ে (বাংলা একাডেমি থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত) আমি অনেক তথ্য পেয়েছি। যেসব তথ্য স্পষ্টভাবে সাক্ষ্য দেয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর কী গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা ছিল। বাংলা ঠিকই রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়। তবে সেই স্বীকৃতি আদায় করতে বিভিন্ন বয়সের ও শ্রেণি-পেশার কয়েকজন ভাষাপ্রেমী মানুষকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়। যা বাঙালির জন্য অত্যন্ত বেদনার আবার অহঙ্কারের বিষয়ও। বাংলাকে অন্যতর রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিলেও বাংলাকে অবহেলা করার মনোবৃত্তি পাকিস্তানিরা চিরদিনই লালন করেছে। ১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু সংসদের দৈনন্দিন কার্যসূচি বাংলা ভাষায় মুদ্রণ করার দাবির মধ্য দিয়েই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী দিনের কার্যসূচি তখন তিনটি ভাষা যথাÑ বাংলা, উর্দু ও ইংরেজিতে মুদ্রিত হওয়ার কথা থাকলেও পাকিস্তানিরা দিনের কর্মসূচি উর্দু আর ইংরেজিতে প্রকাশ করে। এটা নিয়ে বঙ্গবন্ধু উচ্চকণ্ঠ হন এবং তিনি সংসদে যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে বোঝাতে সক্ষম হন যে, পাকিস্তানিরা ইচ্ছে করেই বাংলা ভাষার সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মহান মুক্তিযুদ্ধে চ‚ড়ান্ত বিজয় অর্জন করার পূর্বে বঙ্গবন্ধু যত ভাষণ বিবৃতি প্রদান করেছেনÑ সেসব ভাষণ-বিবৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সুযোগ পেলেই বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে তার জোরালো অবস্থানের কথা ব্যক্ত করেছেন। এমনকি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেও তিনি বাঙালির ‘সাংস্কৃতিক’ মুক্তির কথা স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন শুধু রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক মুক্তি হলেই একটি দেশ উন্নত হতে পারে না, এজন্য প্রয়োজন ‘সাংস্কৃতিক মুক্তি’। আর সাংস্কৃতিক মুক্তি তখনই ত্বরান্বিত হয়, যখন ‘ভাষা’ সগৌরবে সর্বস্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।