শিগগির চালু হচ্ছে মোবাইল অপারেটর সিটিসেল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:২৭ এএম
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের প্রথম সিডিএমএ প্রযুক্তির মোবাইল ফোন অপারেটর সিটিসেল পুনরায় চালু হতে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম মোবাইল ফোন অপারেটরটি ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটির বকেয়া বিল, গ্রাহক কমে যাওয়া, আদালতের আদেশ, তরঙ্গ স্থগিত করাসহ নানান জটিলতায় ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ ৮ বছর পর পুনরায় কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্যে সিটিসেল তাদের লাইসেন্স ফেরত চেয়ে টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির কাছে আবেদন করেছে। বিটিআরসি তাদের লাইসেন্স ফেরত দেয়ার বিষয়ে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী এম মোর্শেদ খানের পরিবারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেডের (পিবিটিএল) সিটিসেলের মূল কোম্পানি। ওই রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে সিটিসেল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ‘বৈষম্যের শিকার হয়’ বলে বিটিআরসিতে জমা দেওয়া চিঠিতে দাবি করা হয়েছে। চিঠিতে আরো বলা হয়, এ ছাড়া, বিটিআরসি তার ক্ষমতার অতিরিক্ত ও অপব্যবহার করে স্পষ্ট বৈষম্যমূলক উদ্যোগ নিয়েছে শুধুমাত্র এই অযৌক্তিক ধারণার ভিত্তিতে যে পিবিটিএল এমন একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যারা তৎকালীন সরকারের পক্ষে ছিল না।
১৯৮৯ সালে বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল ফোন অপারেটর হিসেবে লাইসেন্স পেয়েছিল বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (বিটিএল), যা পরে মালিকানার হাতবদলে সিটিসেল নাম পায়। লাইসেন্স নেওয়ার পরের বছর হংকং হাচিসন টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেড এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে বিটিএল নাম বদলে হয় হাচসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (এইচবিটিএল)। ১৯৯৩ সালে কোম্পানির মালিকানায় আবার পরিবর্তন আসে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানের মালিকানাধীন প্যাসিফিক মোটরস ও ফারইস্ট টেলিকম মিলে এইচবিটিএল-এর শেয়ার কিনে নেয়। তখন কোম্পানির নাম বদলে হয় প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড, ব্র্যান্ডিং শুরু হয় সিটিসেল নামে। পরে ২০০৪ সালে এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে সিঙ্গাপুরের সিংটেল। সিটিসেলের ৪৫ শতাংশ সিংটেলের মালিকানায় এবং ৫৫ শতাংশ মালিকানায় ছিল প্যাসিফিক গ্রুপ ও ফার ইস্ট টেলিকমের।
প্যাসিফিক মোটরস যখন সিটিসেলের মালিকানায় আসে, মোরশেদ খান তখন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিনিয়োগ বিষয়ক বিশেষ দূতের দায়িত্বে। আর এইচ এম এরশাদ সরকারের সময়ে সিটিসেল যখন লাইসেন্স পায়, মোরশেদ খান তখন ছিলেন জাতীয় পার্টির কোষাধ্যক্ষ। দেশে সিডিএমএ প্রযুক্তির একমাত্র মোবাইল অপারেটর ছিল সিটিসেল। ২০১৭ সালের ১১ জুন বিটিআরসি সিটিসেলের তরঙ্গ (স্পেকট্রাম) বন্ধ করে দেয়। সর্বশেষ গত বছর মার্চে সিটিসেলের লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত জানায় বিটিআরসি।
পিবিটিএল-এর রেগুলেটরি অ্যান্ড করপোরেট বিভাগের প্রধান নিশাত আলি খান বলেন, বিটিআরসির সিদ্ধান্তের ‘পুনর্মূল্যায়ন’ চেয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর তারা আবেদনটি জমা দেন। ওই আবেদনে বলা হয়, সিটিসেল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ‘বিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে’ যুক্ত ছিল এমন ধারণা থেকে লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে, যে ধারনাটি ছিল ‘অযৌক্তিক’। “আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, গত আট বছরে বিটিআরসির পক্ষপাতদুষ্ট, অপ্রীতিকর ও অসৎ উদ্দেশ্যে নেওয়া সিদ্ধান্ত ও মূল্যায়নের শিকার হয়েছে সিটিসেলের মূল কোম্পানি পিবিটিএল।”
পৌনে পাঁচশ কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধের জন্য কয়েক দফা তাগাদা দিয়েও তা না পেয়ে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে সিটিসেলের কার্যক্রম বন্ধ করার উদ্যোগের কথা জানায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। পরের মাসে সিটিসেলকে নোটিস দেওয়া হয়। ওই নোটিসের বিরুদ্ধে সিটিসেল হাই কোর্টে যায়। ওই বছরের ২২ অগাস্ট হাই কোর্টের আদেশে বলা হয়, নোটিসের জবাব দিতে বিটিআরসি যে এক মাস সময় দিয়েছিল, ওই সময় পর্যন্ত সিটিসেলকে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। হাইকোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যায় বিটিআরসি। ২৯ অগাস্ট আপিল বিভাগের আদেশে দেনা শোধের জন্য সিটিসেলকে দুই মাস সময় দেয় আপিল বিভাগ। বিটিআরসির পক্ষ থেকে বলা হয়, বকেয়া ৪৭৭ কোটি টাকার মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ প্রথম এক মাসে এবং এক তৃতীয়াংশ পরবর্তী এক মাসে পরিশোধ করতে হবে।
এছাড়া ১৭ অগাস্টের পর থেকে প্রতিদিন বিটিআরসির কাছে পাওনা হওয়া ১৮ লাখ টাকা করে অবিলম্বে পরিশোধের নির্দেশ দিয়ে আদালত বলে, টাকা না পেলে বিটিআরসি যে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে। ২০ অক্টোবর সিটিসেলের তরঙ্গ স্থগিত করে বিটিআরসি। মহাখালীতে সিটিসেলের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেন বিটিআরসি কর্মকর্তারা। তখনকার টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম সেদিন বলেন, একমাসের প্রথম কিস্তিতে নির্ধারিত ৩১৮ কোটি ৪২ লাখ টাকার মধ্যে সিটিসেল মাত্র ১৩০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। এরপর সিটিসেল তরঙ্গ বাতিলের সিদ্ধান্ত স্থগিত বা পুনরায় তরঙ্গ বরাদ্দের নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে যায়। শুনানি শেষে আদালত গতবছর ৩ নভেম্বর আদেশের দিন রাখে। ৩ নভেম্বর সিটিসেলের তরঙ্গ খুলে দিতে বলা হয়।
৩ নভেম্বরের শুনানিতে বিটিআরসি তাদের দাবির পরিমাণ কমিয়ে ৩৯৭ কোটি টাকায় নিয়ে আসে। কিন্তু ওই অংক নিয়েও সিটিসেল আপত্তি তোলে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় কিস্তিতে সিটিসেলকে কত টাকা দিতে হবে তা নির্ধারণ করে দেয় আদালত। বলা হয়, ১৯ নভেম্বরের মধ্যে সিটিসেল ১০০ কোটি টাকা না দিলে বিটিআরসি আবার তরঙ্গ বন্ধ করে দিতে পারবে। এছাড়া আদালত বিটিআরসির সঙ্গে সিটিসেলের বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক ভিসি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। ওই কমিটিকে এক মাসের মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে বলা হয়।
তিন দিনেও তরঙ্গ ফিরে না পেয়ে ৬ নভেম্বর ফের আদালতে যায় সিটিসেল। তাদের আবেদনের শুনানি করে এ বিষয়ে বিটিআরসির ব্যাখ্যা জানতে চায় আপিল বিভাগ। ওইদিন সন্ধ্যায় বিটিআরসির কর্মকর্তারা সিটিসেলে গিয়ে তরঙ্গ ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করেন। কিন্তু এরপর রাজধানীর মহাখালী এলাকার বাইরের সিটিসেল গ্রাহকরা কোনো সেবা বা সংযোগ পাচ্ছিলেন না।
সিটিসেলের আইনজীবী আহসানুল করিমের ভাষ্য অনুযায়ী, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ১৯ নভেম্বরের আগেই ১০০ কোটি টাকা পরিশোধ করে সিটিসেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তারপরও ২০১৭ সালের ২৬ এপ্রিল সিটিসেলকে কারণ দর্শাও নোটিস দেয় বিটিআরসি। কেন তাদের তরঙ্গ বন্ধ করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় সেখানে। সিটিসেল ওই নোটিসের জবাব দিলেও ‘যথাযথ কারণ উল্লেখ না করেই’ ২০১৭ সালের ১১ জুন বিটিআরসি সিটিসেলের তরঙ্গ বন্ধ এবং রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি লাইসেন্স বাতিল করে দেয় বলে আইনজীবীর ভাষ্য। বন্ধ হওয়ার সাত বছরের মাথায় ২০২৩ সালের মার্চে সিটিসেলের লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত জানায় বিটিআরসি।
২০০৭ সালের শেষের দিকে সিটিসেল নতুন লোগো উন্মোচন করে। গ্রাহক সংখ্যার দিক থেকে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম মোবাইল অপারেটর কোম্পানি ছিল। অপারেশন বন্ধের আগে ধীরে ধীরে গ্রাহক হারাচ্ছিল সিটিসেল। সিটিসেল কোড-ডিভিশন মাল্টিপল অ্যাক্সেস (সিডিএমএ) প্রযুক্তি ব্যবহার করতো। যদিও মোবাইল কমিউনিকেশনের জন্য সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল (জিএসএম)। ২০১০ সালে কোম্পানিটির প্রায় ৩০ লাখ গ্রাহক থাকলেও ২০১৬ সালে তা পাঁচ লাখ ৫৯ হাজারে নেমে আসে।
২০১০ সালের প্রথম দিকে সিটিসেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পদে গুরুত্বপূর্ণ রদবদল করা হয়। মেহবুব চৌধুরীকে বানানো হয় প্রধান কার্যনির্বাহী বা সিইও এবং ড্যাভিড লিকে বানানো হয়ে সিওও বা প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তারা নতুন পদে বসেন। ২০১৬ সালের অক্টোবরে যখন সরকার সিটিসেলের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় তখন মেহবুব চৌধুরী প্রধান কার্যনির্বাহী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
কোম্পানিটি সম্পূর্ণ ১০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রামসহ তার সেলুলার মোবাইল ফোন অপারেটর লাইসেন্স এবং রেডিও যোগাযোগ সরঞ্জাম লাইসেন্স পুনরায় পাওয়ার দাবি করেছে। তারা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত টুজি, থ্রিজি, ফোরজি এবং ফাইভজি লাইসেন্স দেওয়ার অনুরোধ করেছে এবং লাইসেন্স ফি না দেওয়ার জন্য ‘বেআইনি ও স্বেচ্ছাচারী’ জরিমানা মওকুফ করার আহ্বান জানিয়েছে।