মৃতকে জীবিত করার দাবি করতেন কথিত ধর্মগুরু ‘ভোলে বাবা’
![Icon](https://www.jugerchinta24.net/uploads/settings/iconicon-2-1716039510.jpg)
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১২:১২ এএম
![মৃতকে জীবিত করার দাবি করতেন কথিত ধর্মগুরু ‘ভোলে বাবা’](https://www.jugerchinta24.net/uploads/2024/07/online/photos/bhole-baba-6686e613edc53.jpg)
ভারতের উত্তর প্রদেশের স্বঘোষিত ধর্মগুরু নারায়ণ সাকার বিশ্ব হরি ওরফে ‘ভোলে বাবা’। ছবি : সংগৃহীত
ভারতে এখন বহুল আলোচিত নাম নারায়ণ সাকার বিশ্ব হরি ওরফে ‘ভোলে বাবা’। গত মঙ্গলবার দেশটির উত্তর প্রদেশে স্বঘোষিত এই ধর্মগুরুর অনুষ্ঠানে গিয়ে অন্তত ১২১ ব্যক্তি পদদলিত হয়ে নিহত হন। আহত হন অনেকে। উত্তর প্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভোলে বাবার অনেক অনুসারী রয়েছেন। অনুসারীরা তাঁকে ‘নিরাময়কারী’ বলে বিশ্বাস করেন। তাঁদের বিশ্বাস, ভোলে বাবা জাদু দিয়ে ‘ভূতে-ধরা’ ব্যক্তিদের সুস্থ করতে পারেন।
২০০০ সালে আগ্রায় ১৬ বছরের মৃত এক কিশোরীকে জীবিত করার কথা বলে পরিবার থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ভোলে বাবা। এই ঘটনায় ভোলে বাবা ও তাঁর কয়েকজন ‘সেবাদারের’ বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। বিস্তারিত তদন্ত শেষে মামলাটির ইতি টানা হয়।
১৯৯০-এর দশকে উত্তর প্রদেশে পুলিশের চাকরি থেকে কনস্টেবল হিসেবে অবসর নেন ভোলে বাবা। রাজ্যের কাসগঞ্জেই তাঁর বাড়ি। পুলিশের চাকরি ছেড়ে নিজেকে ধর্মীয় নেতা ঘোষণা করেন তিনি। এরপর ধীরে ধীরে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাঁর অনুসারীদের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের দলিত পরিবারের মানুষ। এসব মানুষের বড় অংশই দিনমজুর, রাজমিস্ত্রি, কৃষিশ্রমিক, সাফাই কর্মচারী (পরিচ্ছন্নতাকর্মী), ছুতোর বা কার্পেট বিক্রেতা।
গত মঙ্গলবার নিজের বোন তারামতির সঙ্গে হাথরস জেলার রতি ভানপুর গ্রামে ‘সৎসঙ্গে’ গিয়েছিলেন ঊর্মিলা দেবী। তিনি বলেন, ভোলে বাবা তাঁদের কাছ থেকে কোনো অর্থকড়ি বা অন্য কোনো নৈবেদ্য চান না। সৎসঙ্গে বা ধর্মসভায় অনুসারীদের তিনি ভালো কাজ করতে বলেন। মিথ্যা না বলতে, মাংস, মাছ, ডিম না খেতে বা মদ না পান করতে উপদেশ দেন।
মঙ্গলবার ভোলে বাবার অনুষ্ঠানে যাঁরা আহত হয়েছেন, তারামতি তাঁদের একজন। তারামতি ও ঊর্মিলা দেবী—এই দুই বোন থাকেন উত্তর প্রদেশের মথুরায়। এবার নিয়ে ভোলে বাবার ধর্মানুষ্ঠান বা সৎসঙ্গে চারবার অংশ নিয়েছেন তারামতি। এবারই প্রথম বোনকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এই দুই বোনের মতো ভোলে বাবার নারী ভক্তদের বয়স ৪০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে।
মঙ্গলবারের অনুষ্ঠানের কথা স্মরণ করে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তারামতি বলেন, সৎসঙ্গ যখন শেষের দিকে তখন ভোলে বাবা বলেন, ‘আজ প্রলয় আ-য়েগি, আওর ফির প্রলয় আ-গেয়ে (আজ প্রলয় হবে, সত্যি সত্যি প্রলয় হলো)।’
হাথরস জেলার ডনকেলি গ্রামের বাসিন্দারা জানান, প্রতি গ্রামে ভোলে বাবার ১০ থেকে ১২ জন সেবক রয়েছেন। প্রতি সৎসঙ্গের আগে গ্রামবাসীকে তাঁরা তা কোথায় হচ্ছে, কীভাবে যেতে হবে, তা জানান। আগ্রহীদের সৎসঙ্গস্থলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। অনুসারীদের অনেকে নিজেদের গলায় ভোলে বাবার ছবিসংবলিত হলুদ লকেট পরেন।
মঙ্গলবার বিকেলে রতি ভানপুরের পদদলিত হয়ে শতাধিক মানুষের মৃত্যু সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ বলছে, ভক্তরা ভোলে বাবার পদধূলি নিতে হুড়োহুড়ি শুরু করেছিলেন। তাই পদদলনের ঘটনা ঘটেছে। এই গ্রামের রিকশাচালক বিবেক ঠাকুর বলেন, ভোলে বাবার ভক্তরা মনে করেন তাঁর পদধূলি শরীর বা মাথায় মাখলে শরীরের সব রোগ ভালো হয়ে যায়।
মঙ্গলবার সৎসঙ্গে হাথরসের সোখানা গ্রামের চার বাসিন্দা মারা যান। গ্রামটির বাসিন্দারা জানান, ভোলে বাবা নিয়মিত ভূত ঝাড়েন। তাঁর কাছে ভূত ঝাড়তে আসা ব্যক্তিদের অধিকাংশই তরুণী বা কিশোরী। রতি ভানপুর গ্রামের সৎসঙ্গে ভোলে বাবা ১০০ জনের বেশি ভূতে-ধরা ব্যক্তিকে সুস্থ করেছেন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি।
উত্তর প্রদেশের সিকান্দ্রা রাওয়ের সামাদপুরা গ্রামের কয়েকজন নারী বলেন, ‘ভোলে বাবা ভালো কাজ করতে বলেন। ভালো কাজ করলে পরজনমে পুরস্কার পাওয়া যাবে বলেও জানান তিনি। ভালো পথ অনুসরণ করলে পরজনমে আমাদের অবস্থা ভালো হবে বলে আশ্বস্ত করতেন তিনি।’
আরেক ভক্ত বলেন, ‘২০০১ সালে আমি যখন বিয়ে করি, তখন ভোলে বাবা এত বিখ্যাত ছিলেন না। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। কেউ সাতবারের বেশি তাঁর সৎসঙ্গে অংশ নিলে তিনি সেবকে পরিণত হন। সেবকদের বিশেষ ধরনের পোশাক রয়েছে। নারী সেবকেরা গোলাপি শাড়ি পরেন। পুরুষেরাও একই রঙের পোশাক পরেন।’
২০০০ সালের মার্চে ভোলে বাবা গ্রেপ্তার হয়েছেন উল্লেখ করে আগ্রার শাহগঞ্জের তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তা তেজবীর সিংহ বলেন, ‘১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীর মরদেহ শ্মশানে আনা হলে দুই থেকে আড়াই শ সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে সুরাজ পাল (ভোলে বাবা) সেখানে হাজির হন। সুরাজ পাল ও তাঁর অনুসারীরা মেয়েটির পরিবারকে শেষকৃত্যে বাধা দেন। মেয়েটির পরিবারকে বোঝানো হয়, তিনি মেয়েটিকে জীবিত করবেন।’
থানার নথিপত্র থেকে জানা যায়, মৃত মেয়েটির নাম স্নেহ লতা। মেয়েটির মরদেহ ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগে মামলাটি হয়েছিল ২০০০ সালের ১৮ মার্চ।
২০১৯ সালে ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে অবসরে যাওয়া তেজবীর সিংহ বলেন, ‘পরিবার থানায় অভিযোগ করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ঘটনাস্থলে যাই। তখন সুরাজ পাল ও তাঁর অনুসারীরা আমাদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি শুরু করেন। তিনি (ভোলে বাবা) বারবার দাবি করছিলেন, তিনি মেয়েটিকে জীবিত করতে পারবেন। ঘটনার একপর্যায়ে তাঁর ভক্তরা পুলিশের ওপর পাথর নিক্ষেপ শুরু করেন। তখন অতিরিক্ত পুলিশ ডাকা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে আমরা সুরাজ পালসহ তাঁর সহযোগীদের গ্রেপ্তার করি।’
ওই ঘটনায় শাহগঞ্জ থানায় সুরাজ পাল ও তাঁর স্ত্রীসহ মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছিল। বাকি চারজনের মধ্যে দুজন নারী, আর দুজন পুরুষ। ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১০৯ ধারায় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছিল।
এই মামলা সম্পর্কে জানতে আগ্রা থানা-পুলিশের বর্তমান ডেপুটি কমিশনার সুরাজ কুমার রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ভোলে বাবা ও অন্যদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, তদন্ত শেষে এই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল। প্রমাণের ভিত্তিতে পরে মামলাটির আরও বিস্তারিত তদন্ত হয়েছিল। তবে ২০০০ সালের ২ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।