পাকিস্তানে ট্রেন ছিনতাই : বেলুচ লিবারেশন আর্মি কে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৫, ১০:০১ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে যাত্রীবাহী ট্রেন ছিনতাইয়ের ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে বেলুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। প্রায় ৪৫০ জন যাত্রীকে জিম্মি করে রাখা এই গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীন বেলুচিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে সশস্ত্র বিদ্রোহ চালিয়ে আসছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৫০ জন যাত্রীকে উদ্ধার করেছে এবং অভিযানের সময় ২৭ জন জঙ্গিকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে। তবে, পাল্টা হামলায় ট্রেনের চালকসহ ১০ যাত্রী নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
বিএলএ এই হামলার দায় স্বীকার করে জানিয়েছে, তাদের বন্দি সদস্যদের মুক্তি দেওয়া হলে জিম্মিদের ছেড়ে দেওয়া হবে। তবে পাকিস্তান সরকার তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে এবং শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জিম্মিদের উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে। আলজাজিরার প্রতিবেদনে জানা যায়, ছিনতাই হওয়া ট্রেনটির নাম ‘জাফর এক্সপ্রেস’, যা বেলুচিস্তান থেকে খাইবার পাখতুনখোয়া পর্যন্ত চলাচল করে। এটি মূলত সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের চলাচলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় অতীতে বহুবার হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে।
এর আগেও এই ট্রেনে একাধিকবার হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে কোয়েটা স্টেশনে আত্মঘাতী হামলা চালানো হলে ৩০ জন নিহত হন। এছাড়া, জঙ্গিরা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বেলুচিস্তানের একটি বড় অংশের রেললাইন ধ্বংস করেছিল, যার ফলে দুই মাস ধরে জাফর এক্সপ্রেস চলাচল বন্ধ ছিল। গত বছরের জানুয়ারিতেও একটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, যাতে ১৩ জন আহত হন। তবে এবারের ঘটনা পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো পুরো একটি ট্রেন ছিনতাইয়ের নজির সৃষ্টি করেছে, যা বিশ্বদৃষ্টিতেও বিরল।
বেলুচিস্তান পাকিস্তানের আয়তনে সবচেয়ে বড় কিন্তু সবচেয়ে কম উন্নত প্রদেশ। এখানে প্রায় ১.৫ কোটি মানুষের বসবাস থাকলেও তারা বহু বছর ধরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার। প্রাকৃতিক গ্যাস, তামাসহ বিভিন্ন খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও, এখানকার জনগণ উন্নয়নের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। পাকিস্তান সরকার এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের অভিযোগ রয়েছে, যা বেলুচ জনগণের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব গড়ে তুলেছে। এই অসন্তোষ থেকেই বেলুচ লিবারেশন আর্মি দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়ার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
বিএলএ মনে করে, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের স্বার্থ উপেক্ষা করছে এবং সম্পদ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। এই কারণে তারা সরকারি বাহিনী, কৌশলগত স্থাপনা এবং বিশেষ করে চীনা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর ওপর নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) প্রকল্পের কারণে এই বিদ্রোহ আরও বেড়ে গেছে। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ৬২ বিলিয়ন ডলারের এই উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে বেলুচিস্তানের গদর বন্দরসহ বিভিন্ন স্থানে অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মনে করে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের ভূমি দখল করা হচ্ছে এবং বেলুচ জনগণকে আরও কোণঠাসা করা হচ্ছে। ফলে তারা চীনা নাগরিক ও অবকাঠামোর ওপর ধারাবাহিক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে চীনের বেশ কিছু নাগরিক নিহত হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে বেলুচিস্তানে সহিংসতার মাত্রা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত মাসে কালাত শহরে বিএলএ-এর হামলায় ১৮ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হন। এর আগে এক নারী আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্যকে হত্যা করেন। বিশ্লেষকদের মতে, বিএলএ এখন আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়েছে এবং তারা বড় ধরনের হামলা চালানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে। পাকিস্তান সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, কারণ তারা এখনো পুরোনো কৌশল ব্যবহার করছে, যা বর্তমান পরিস্থিতির জন্য যথেষ্ট কার্যকর নয়।
ওয়াশিংটনভিত্তিক বেলুচিস্তান বিশেষজ্ঞ মালিক সিরাজ আকবর বলেন, একসময় বিএলএ ছোটখাটো হামলা চালাত, যেমন গ্যাস পাইপলাইন উড়িয়ে দেওয়া বা বিচ্ছিন্ন হামলা করা। কিন্তু এখন তারা বড় ধরনের অপারেশন পরিচালনা করছে, যা দেখাচ্ছে যে, পাকিস্তান সরকার তাদের দমন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, একটি যাত্রীবাহী ট্রেনে হামলা চালানো তাদের আত্মবিশ্বাস ও শক্তির ক্রমবর্ধমানতা প্রকাশ করে। এত বড় সন্ত্রাসী হামলার পরেও যদি পাকিস্তান সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তবে এটি সরকারের দুর্বলতারই প্রতিফলন।
অপরদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক রফিউল্লাহ কাকর বলেন, বিএলএ তাদের সাংগঠনিক কাঠামো আরও শক্তিশালী করেছে এবং তাদের সদস্যদের স্বাধীনভাবে হামলা পরিচালনার ক্ষমতা দিয়েছে। এছাড়া, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র যে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ফেলে গেছে, তার একটি অংশ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে তারা। ফলে এখন আরও আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে মারাত্মক হামলা চালানোর ক্ষমতা অর্জন করেছে এই গোষ্ঠী।
পাকিস্তান সরকার ২০২৩ সালে বেলুচিস্তানে বড় সামরিক অভিযান চালানোর ঘোষণা দিলেও, তা কখনো কার্যকর হয়নি। যদিও পাক সেনাবাহিনী মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত অভিযান চালায়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা সাধারণ জনগণের ওপর দমন-পীড়নে পরিণত হয়। স্থানীয় জনগণের প্রতি সরকারের বৈষম্যের ফলে বিএলএ আরও শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, শুধুমাত্র সামরিক অভিযান দিয়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
বেলুচিস্তানের সংকট সমাধানের জন্য বেলুচ জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সরকারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব ঘোচাতে হবে এবং তাদের প্রতি নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে। তা না হলে, বিদ্রোহ দমনের পরিবর্তে আরও তীব্র হবে এবং পাকিস্তানের জন্য এটি আরও বড় সংকটে রূপ নিতে পারে।
সূত্র: আলজাজিরা।